শেয়ার বিজ ডেস্ক : বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূলে বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা সমুদ্রবন্দরকে আধুনিকায়ন ও কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বন্দরটির কনটেইনার পরিচালন ক্ষমতা বাড়াতে এবং এটিকে আধুনিক ও বিশ্বমানের নৌ-যোগাযোগ কেন্দে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকারের পাঁচটি প্রকল্প পরিকল্পনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত একটি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং আরও চারটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। একনেক ইতোমধ্যে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে এবং আরও তিনটি প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খবর বাসস।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের (এমপিএ) উপপরিচালক (মিডিয়া) মো. মাকরুজ্জামান গতকাল গণমাধ্যম’কে জানান, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এমপিএ ‘মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও তেল নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জাহাজ ও আশপাশের শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করা হবে। এটি সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক ‘মারপল কনভেনশন’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা সুন্দরবন ও পশুর চ্যানেলকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
মো. মাকরুজ্জামান বলেন, বাকি চারটি প্রকল্পের নির্মাণকাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। চলমান এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- জরুরি সেবা ও কার্যকর পরিচালনার জন্য সহায়ক জলযান সংগ্রহ, পশুর চ্যানেলের ‘ইনার বার’ এলাকায় ৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতা অর্জনের লক্ষ্যে ড্রেজিং করা, যাতে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজগুলো ওই চ্যানেল দিয়ে নিরাপদে চলাচল করতে পারে। এছাড়া রয়েছে- মোংলা বন্দরকে বছরে ১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্গো এবং সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টিইইউ (২০ ফুটের সমমান ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আধুনিকায়ন এবং দুটি অসমাপ্ত জেটি নির্মাণ, যা বছরে ২ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সম্ভব করবে এবং সংশ্লিষ্ট খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
একনেক যে দুটি প্রকল্প সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে, তার মধ্যে একটি হলোÑ বন্দরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্র্রসারণ ও আধুনিকায়ন, যার আওতায় আধুনিক যন্ত্রপাতি বসানো হবে এবং ৪ লাখ টিইইউ পর্যন্ত কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়বে। আরেকটি হলো- মোংলা বন্দর চ্যানেলে রক্ষণাবেক্ষণমূলক ড্রেজিং। অন্য তিনটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেগুলো হলো- একটি ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার এবং দুটি কাটার সাকশন ড্রেজার সংগ্রহ, পশুর চ্যানেলে নদীশাসন বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দুটি মুরিং বোট সংগ্রহ।
এমপিএ’র প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা জহিরুল হক বলেন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বন্দর কার্যক্রম অনেক গতি পেয়েছে। দুটি জেটিসহ চারটি প্রকল্পের অন্তত ৮০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই বাকি কাজ শেষ হওয়ার আশা করছি। তিনি বলেন, চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর জেটিতে অতিরিক্ত ১০০টি জাহাজ ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দে আরও ১৩০টি জাহাজ হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে। ফলে লোড-আনলোডিং সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে মোংলা বন্দর একটি বড় আঞ্চলিক কেন্দ হিসেবে গড়ে উঠবে।
ভৌগোলিক দিক থেকে মোংলা বন্দরের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বন্দর দিয়ে নেপাল, ভুটান, চীন ও ভারতের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর আগ্রহের কারণে বন্দরের ওপর চাপ বাড়ছে। এজন্য এর সম্প্র্রসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও জানান তিনি।
এমপিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে মোংলা বন্দরে জাহাজজট নেই। ফলে ব্যবহারকারীরা ভালো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য বিশেষ সুবিধা, সাতটি কনটেইনার ইয়ার্ড, ৩৮টি সহায়ক জলযান (যেমন- টাগবোট, পাইলট বোট, সার্ভে বোট, ড্রেজার) রয়েছে। আন্তর্জাতিক ‘শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএস)’ কোড অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল এবং সহজলভ্য সড়ক ও নদীপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগও রয়েছে।
জেটিতে ৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর সক্ষমতা, ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলে পানির ওপরে ভাসমান নৌযান সংকেত যন্ত্র ও টাওয়ার দিয়ে রাত-দিন নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা, বিদেশি জাহাজের জন্য ৪৯টি নির্ধারিত বার্থিং পয়েন্ট, ১৩৪টি আধুনিক কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং যন্ত্র, নিরাপদ সংরক্ষণ সুবিধাসহ খুলনার রুজভেল্ট জেটিতে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু রয়েছে, যার আওতায় অনুমতি, বিল, ইনডেন্টিং, যন্ত্রপাতি বুকিং ও পেমেন্ট একই জায়গায় করা যায়।
অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে ১৮২ মিটার দীর্ঘ পাঁচটি জেটি, ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার চারটি ট্রানজিট শেড, একটি স্টাফিং-আনস্টাফিং শেড, দুটি ৩০ হাজার টনের গুদাম, ১৬২টি রিফার প্লাগ, সাতটি কনটেইনার ইয়ার্ড এবং দুটি গাড়ির ইয়ার্ড।
বন্দরের ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দুলাল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়ার কারণে বন্দরের কার্যক্রম অনেক গতি পেয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে বন্দরে কাজের গতি আরও বাড়বে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের (এমপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মোংলা বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটিকে একটি আঞ্চলিক কেন্দ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি জানান, বন্দরের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌ-চ্যানেলের নাব্য রক্ষা, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব নিরাপদ চ্যানেল নিশ্চিত করা, ভবিষ্যৎ চাহিদা অনুযায়ী সক্ষমতা বাড়ানো, পুরোনো নৌযান প্রতিস্থাপন ও নতুন নৌযান সংগ্রহ, মেরামত সুবিধা গড়ে তোলা এবং দক্ষ জনবল তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হবে।
এমপিএ চেয়ারম্যান জানান, বর্তমানে মোংলা বন্দরের বার্ষিক সক্ষমতা হলো ১ হাজার ৫০০টি জাহাজ হ্যান্ডলিং, ১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্গো, এক লাখ টিইইউ কনটেইনার এবং ২০ গাড়ি হ্যান্ডলিং।

Discussion about this post