শেয়ার বিজ ডেস্ক : ব্যাংক খাতের আলোচিত এননটেক্স গ্রুপের সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায়ে অবশেষে মামলা করেছে জনতা ব্যাংক। অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া এসব ঋণ ২০১৯ সালে খেলাপি হয়। মামলার পর আদালত এক আদেশে বলেছেন, যেসব কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলা ও যোগসাজশের কারণে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এত দেরি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়ে আদালতকে অবহিত করতে হবে। বৃহস্পতিবার ঢাকার অর্থঋণ আদালত ৫-এর বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ আদেশ দেন। প্রসঙ্গত, এর আগে এননটেক্সের ঋণ জালিয়াতি নিয়ে দুদক একাধিক মামলা করে।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে এননটেক্স গ্রুপের সিমরান কম্পোজিটের বিরুদ্ধে গত বুধবার মামলা রুজু হয়েছে। মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত জানিয়েছেন, একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন করে এননটেক্স গ্রুপকে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয় ২০১২ সালে। বারবার সুদ মওকুফ ও ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় পাওয়ার পরও পরিশোধ করেননি গ্রাহক। ঋণ আদায়ে ২০১৯ সালে মামলা করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। এর পরও আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে একের পর এক সুদ মওকুফ করা হয়। ঋণ বিতরণ এবং বারবার সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যাংকিং নিয়মাচার লঙ্ঘন হয়েছে। ২০২২ সালের পর গ্রাহক এক টাকাও পরিশোধ করেননি। ওই সময়ে ঋণ পুনঃতপশিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের টাকাও পরিশোধ করেননি গ্রাহক। এর পরও ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে গ্রাহককে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ অবারিত রাখা হয়।
জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এননটেক্স গ্রুপের কাছে বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বেশি। বিগত সরকারের সময়ে এককালীন এক্সিট সুবিধার আওতায় ২০২২ সালের নভেম্বরে শর্তসাপেক্ষে এননটেক্স গ্রুপকে তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে জনতা ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। মওকুফ-পরবর্তী চার হাজার ৮১৯ কোটি টাকা পরিশোধে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। ওই সময় এননটেক্স গ্রুপের কাছে সুদসহ ব্যাংকের পাওনা ছিল আট হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২৩ সালে ১৪২ কোটি টাকার সুদ যোগ হয়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এরপর ২০২৪ সালের মার্চে এসে সুদ মওকুফ সুবিধা বহাল রেখে চার হাজার ৯৬১ কোটি টাকা পরিশোধে আরও দুই বছর সময় দেয় ব্যাংক।
ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার হিসেবে প্রথমে গ্রুপটিকে ৩০ কোটি টাকা জমা এবং পরপর দুটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সুবিধা বাতিলের শর্ত দেওয়া হয়। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদয় পাওনা পরিশোধের কথা। এ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে ঋণ পরিশোধের যে শর্ত ছিল, তা পরিপালন হয়নি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পরিবর্তন এসেছে। নতুন কর্তৃপক্ষ এসে গত বছরের ডিসেম্বরে এননটেক্সের জমি বিক্রির জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও ক্রেতা পায়নি। এননটেক্স গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশুলিয়া ও টঙ্গীর তুরাগ নদ-সংলগ্ন প্রায় ১২৮ একক জমি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে।
আদালতের আদেশে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও এননটেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা না করে ব্যাংক ‘ট্রাস্টি অব পাবলিক মানি’ হিসেবে চরম দায়িত্বহীন আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেসব কর্মকর্তার অবহেলা এবং যোগসাজশের কারণে আইনগত কার্যক্রম থেকে ব্যাংক বিরত থেকেছে, তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনগত কার্যক্রম নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তার দায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এড়াতে পারেন না। যেসব কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে এতদিন মামলা করা সম্ভব হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ৯০ দিনের মধ্য আদালত এবং সরকারকে অবহিত করার জন্য আদেশের কপি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে সার্ভেয়ার দিয়ে বন্ধকি সম্পত্তির পুনর্মূল্যায়নের কাজ শেষ করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানান, আদালতের আদেশের বিষয়টি তিনি অবহিত। অন্যদিকে, ব্যাংকের এমডি মজিবর রহমানের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এককালীন এক্সিট সুবিধার আওতায় শর্ত অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ না করলেও ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে এননটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শব মেহের স্পিনিং মিলস ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। ‘মুরাবাহা টিআর’ পদ্ধতিতে এই ঋণ দেয় ব্যাংকটি। এ পদ্ধতিতে পণ্য কেনার জন্য ঋণ দেওয়া হয়। তবে পুরো অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার সুযোগ পায় এননটেক্স। ওই সময় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে।
এস এস/
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post