Print Date & Time : 15 August 2025 Friday 6:08 am

এবার জাফলংয়েও পাথর লুট, শঙ্কিত পর্যটকরা

অরণ্য আজাদ :  দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোয় চলছে পাথর লুটের মচ্ছব। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটনকেন্দে র পাথর লুট। নদীর তলদেশে বড় বড় গর্ত, ঘোলা পানি আর পাথরশূন্য মরুভূমি যেন এখানে নতুন বাস্তবতা।

এবার সিলেটের আরেক পর্যটন এলাকা জাফলংয়েও পাথর লুট করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, বালুমহাল ইজারা নিয়ে বালুর পাশাপাশি পাথর উত্তোলন করছে অসাধু চক্র। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

জাফলং জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে এরইমধ্যে বড় বড় পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভ জানিয়েছেন পর্যটকরা।

তবে প্রশাসনের দাবি, পাথর লুট ঠেকাতে টহল বাড়ানো হয়েছে। আরেক পর্যটনকেন্দ  সাদাপাথর প্রকাশ্যে লুটপাটে অনেকটা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পাথর লুটের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও পুলিশ রহস্যজনক কারণে তাদের গ্রেপ্তার করছে না। উল্টো প্রতিবাদকারীদের চাঁদাবাজ বানিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

জাফলং সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ । ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এর গেজেট প্রকাশ করা হয়।

ইসিএ ঘোষণার পর জাফলংয়ে বালু ও পাথর কোয়ারির ইজারা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পাথরের মজুত পরিমাপের মধ্যে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সংরক্ষিত এলাকায় পাথর পর্যবেক্ষণ করা হতো। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৬ জুলাইয়ে করা পরিমাপ অনুযায়ী, জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি পাথর লুট হয়েছে জাফলংয়ে। দাবি করা হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়ে যায়, যার বাজার মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। এ সময় পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হয়।

এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি মামলা দায়ের করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সিলেটের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (পরিবেশ) ২২ জনের বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মামুনুর রশীদ। পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বাদী হয়ে ৯২ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন। মামলা দুটি বিচারাধীন আছে।

মামলায় জাফলং থেকে ১২০ কোটি টাকার পাথর লুটের কথা উল্লেখ করা হয়। গোয়াইনঘাট থানায় দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেনÑজাফলং এলাকার চৈলাখেল গ্রামের বাসিন্দা ও সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক (পরে পদ স্থগিত) রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ, জাফলং বাজারের বাসিন্দা ও গোয়াইনঘাট উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও বিলুপ্ত হওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনসহ ৯২ জন। আসামিদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ বিএনপির সমর্থক এবং ৩০ শতাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থক। তবে এই চক্র এখনও বালু ও পাথর লুটপাট অব্যাহত রেখেছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই পাথরখেকোরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামলা হলেও পাথর লুট থেমে নেই।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি বালুমহাল ইজারা দেয় সিলেট জেলা প্রশাসন। পিয়াইন নদীর বালুমহাল লিজ নিয়ে বালুর সঙ্গে পাথরও তুলছে ইজারাদার চক্র। মূলত বালু নয়, পাথরের দিকেই তাদের চোখ।

পশ্চিম জাফলংয়ের এক বাসিন্দা বলেন, বালুমহালের ইজারা সাইনবোর্ড মাত্র। আসলে পাথরই তাদের টার্গেট। পুলিশ জড়িত থাকায় কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে চাঁদাবাজ বানিয়ে দেয়া হয়। এমনকি গ্রেপ্তার করা হয়। এ ভয়ে অনেকে মুখ খুলছেন না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেছেন, বিগত সময়ে প্রশাসন কঠোর হওয়ার কারণে জাফলং তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেতে যাচ্ছিল। ৫ আগস্টের পর সব বদলে গেলে। মানুষজনও হিংস্র হয়ে উঠল। সেই থেকে পাথর লুট থেমে নেই।

তিনি বলেন, পাথর লুটপাটে কারা জড়িত, সবাই জানে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কেন কঠোর হয় না, সেটাও সবার জানা।

জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। পাথর লুটের সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ৫ আগস্টের পরে লুটপাটের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আমরা প্রশাসনকে বলব, ওদের যেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। আইন প্রয়োগ করছি। আমাদের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। বালুমহাল আগ থেকেই ইজারা দেয়া হতো। এরা বালুর কথা বলে পাথর তুললে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পরিবেশবিদরা বলছেন, সাদা পাথরের মতো শিলা বা গলিত ক্যালসাইট জমাট বাঁধতে হাজার থেকে লাখ বছর সময় লাগে। ভোলাগঞ্জের মতো জায়গায় যেসব সাদা পাথর দেখা যায়, সেগুলো মূলত পাহাড়ি খনিজ ও শিলার ক্ষয়প্রক্রিয়ায়, নদীর স্রোত ও আবহাওয়ার প্রভাবে ধীরে ধীরে ভেঙে ও গড়িয়ে এসে নদীতটে জমেছে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীর, প্রাকৃতিকভাবে মানুষের জীবদ্দশায় নতুন করে একই রকম বড় আকারে তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই যদি বর্তমানের মতো অবৈধ পাথর উত্তোলন, নদী খনন ও পরিবেশের ক্ষতি চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজš§ হয়তো ভোলাগঞ্জের আসল সৌন্দর্যÑস্বচ্ছ জল, পাথরের প্রাকৃতিক মেঝে, পাহাড়ি ঝরনার ধারাÑএভাবে আর দেখতে পাবে না। কিন্তু যদি এখনই কঠোর সংরক্ষণ ব্যবস্থা, পর্যটন নিয়ন্ত্রণ এবং পাথর উত্তোলন বন্ধ করা যায়, তাহলে এই সৌন্দর্য বহু প্রজš§ টিকে থাকতে পারে। প্রকৃতি এই সম্পদ বানাতে যে সময় নেয়, আমরা চাইলে তা কয়েক দশকেই নষ্ট করে ফেলতে পারি। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনায় শত শত বছর ধরে রেখে যাওয়া সম্ভব।

এদিকে সিলেট সাদা পাথরে নজিরবিহীন লুটপাটের ঘটনায় তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বুধবার দুদকের একটি দল সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ  পরিদর্শন করে। পাথর লুটপাটের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও অনেক তথ্য পেয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশ ও প্রশাসনের দায় রয়েছে মন্তব্য করেন দুদক কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে সিলেটে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে অভিযান শুরু করেছে যৌথবাহিনী। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে এ অভিযান শুরু হয়। সারারাত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলে। এসব অভিযানে পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক জব্দ করা হয়। এসব পাথর আবার সাদা পাথরে প্রতিস্থাপন করা হবে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর লুটকারীদের তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে লুট হওয়া সব পাথর সাত দিনের মধ্যে আগের জায়গায় ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।