নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে ড্যাফোডিল গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধে উদ্যোগ নিয়েছিল ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স। কিন্তু প্রথম দফায় কিছু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এখন আবার সেই ঋণ পরিশোধ করতে গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে নতুন শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানান দেয় ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স। এর আগের দিন সোমবার অনুষ্ঠিত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়।
ঘোষিত তথ্য অনুযায়ী, ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার সাধারণ শেয়ার ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের ইস্যু মূল্য ধরা হয় ১৫ টাকা। এই শেয়ার ইস্যু করে কোম্পানিটি ৪৯ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে চায়।
ড্যাফোডিল ফ্যামিলি কনসার্নের নামে এ শেয়ার ইস্যু করা হবে। ড্যাফোডিল ফ্যামিলি কনসার্নের কাছ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ শেয়ারে রূপান্তর করা হবে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদনসাপেক্ষে শেয়ার ইস্যুর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে তার আগে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি নিতে হবে। এ লক্ষ্যে কোম্পানিটি আগামী ২৯ ডিসেম্বর বিশেষ সাধারণ সভা আহ্বান করেছে। রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২ ডিসেম্বর।
জানা গেছে, এর আগে একবার ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের শেয়ার ইস্যু নিয়ে অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গত জুলাইয়ে তদন্তে নামে বিএসইসি। দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনও করা হয়। কমিটিকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিল বিএসইসি। তদন্তের বিষয়টি ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সবুর খানও জানতেন।
ওই সময় অভিযোগ ছিল, ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের ২৭তম বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বেশিরভাগ শেয়ারহোল্ডারের মতামতকে মূল্যায়ন না করে অবৈধভাবে কোম্পানির পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনদের নামে নতুন ৪ কোটি ৬৭ লাখ শেয়ার ১০ টাকা ফেস ভ্যালুতে ইস্যু করার এজেন্ডা পাস করা হয়।
সে সময় ওই কোম্পানির পর্ষদ ড্যাফোডিল গ্রুপের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তার বিপরীতে শেয়ারে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা করে ৪.৬৭ কোটি শেয়ার ইস্যু করার অনুমোদন দেয় ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের পরিচালনা পর্ষদ, যা বিএসইসির অনুমোদন সাপেক্ষে করার কথা ছিল। তবে এর আগে কোম্পানিকে এ বিষয়ে এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোম্পানি তা করেনি। ফলে অবৈধভাবে শেয়ার ইস্যু করার অভিযোগ ওঠে।
এমতাবস্থায় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর সেকশন ২১-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে অনুসন্ধান পরিচালনা করার নির্দেশ দেয়া হয়। তদন্ত কমিটিকে ৬০ কার্মদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান সম্পন্ন করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
তবে শেষ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখলেও শেয়ার ইস্যুর বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স পর্ষদকে।
এ বিষয়ে ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের কোম্পানি সচিব মো. মনির হোসেন গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের পর্ষদ ড্যাফোডিল গ্রুপভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য এই শেয়ার ইস্যু করবে। এ বিষয়ে আমরা ডিএসই ও সিএসইতে ঘোষণা দিয়েছি। বিএসইসির অনুমোদন সাপেক্ষে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স। সর্বশেষ হিসাববছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ০.০১ টাকা। আগের হিসাববছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ০.৫৪ টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ১৩.২৪ টাকা।
ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৬ সালে। বর্তমানে কোম্পানিটি ‘বি’ ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে। এ কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ৪৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৪ কোটি ৯৯ লাখ ১২ হাজার ২৬২টি।
২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে ৪১.৪০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৪.১১ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.১০ টাকা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৪.৩৯ শতাংশ শেয়ার আছে।
এ কোম্পানির স্বল্পমেয়াদি ঋণ আছে ২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। গতকাল মঙ্গলবার কোম্পানির শেয়ারের সর্বশেষ লেনদেন মূল্য ছিল ৩৪.৪০ টাকা।
ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স ড্যাফোডিল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি আইটি সলিউশন, কম্পিউটার অ্যাসেম্বলিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের ব্যবসা করে। তাছাড়া ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের প্রতিনিধিত্ব করা এমডি সবুর খান ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য। তিনি বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। গত ১৭ জুলাই তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিগত সরকারের আমলে তিনি শিক্ষাব্যবসা, টেস্টেড সফটওয়্যার, মেডিকেল সফটওয়্যার, ফার্মাসি ম্যানেজমেন্ট এবং ইআরপি সফটওয়্যারের একচেটিয়া ব্যবসা করেন। তার কোম্পানির বিরুদ্ধে পাইরেটেড সফটওয়্যার সরবরাহেরও অভিযোগ ছিল।
জানা যায়, সবুর খানের ব্যবসার সূত্রপাত হয়েছিল ঢাকার ১০১/এ, গ্রিন রোডে। সেখানেই ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের শুরু। ১৯৯৮-৯৯ সালে তিনি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কম্পিউটার আমদানি শুরু করেন। এরপর হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার ব্যবসায় সম্প্রসারণ হয়।
সূত্র জানায়, ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের শেয়ার নিয়ে ব্যাপক কারসাজির কারণে তিনজনকে ছয় লাখ টাকা জরিমানাও করেছিল বিএসইসি।
প্রিন্ট করুন






Discussion about this post