Print Date & Time : 15 November 2025 Saturday 6:02 pm

এলএনজি নির্ভরতা বাড়লে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হবে

রামিসা রহমান : আগামী এক দশকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)। সংস্থাটির ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক ২০২৫ প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, যা গত বুধবার প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের জ্বালানির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, অথচ দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের জ্বালানি অবকাঠামো নানা দুর্বলতার মুখে পড়েছে। এই তিনটি বিষয়-চাহিদার চাপ, মজুতের ঘাটতি ও জলবায়ু ঝুঁকিÑএকত্রে বাংলাদেশের জ্বালানি ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

আইইএর হিসাব অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ এলএনজি আমদানি প্রায় ৮০ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) পৌঁছাবে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ দুই দেশই আগামী এক দশকে আরও বেশি পরিমাণে গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকবে। অর্থাৎ আগামী দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ আরও গভীরভাবে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের ওঠানামার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

একসময় দেশের জ্বালানি খাত গ্যাসভিত্তিক স্বনির্ভর ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। সিলেট, বিবিয়ানা ও তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া সরবরাহেই চলত বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন অতীত। বর্তমানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, অথচ শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়েই চলেছে।

ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে। তখন লক্ষ্য ছিল ‘অন্তর্বর্তী সমাধান’। কিন্তু এখন ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছেÑএই ‘অন্তর্বর্তী নির্ভরতা’ পরিণত হয়েছে একটি স্থায়ী অভ্যাসে। এখন দেশের মোট গ্যাস ব্যবহার্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই আসে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে।

একসময় প্রাকৃতিক গ্যাসে প্রায় স্বনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস ব্যবহার্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই আমদানিনির্ভর। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে জ্বালানির দাম ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ।

আইইএ বলেছে, উচ্চ আমদানি মূল্য, সীমিত সংরক্ষণ ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার (রিগ্যাসিফিকেশন) সক্ষমতা এবং জলবায়ু ঝুঁকিÑএই সবকিছু মিলে এলএনজিনির্ভর বর্তমান মডেলকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালে একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার ঘটনায় বাংলাদেশের উপকূলীয় গ্যাস টার্মিনাল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় এলএনজি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে এবং একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আইইএর ভাষায়, এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিয়েছে যে উপকূলীয় জ্বালানি স্থাপনাগুলো জলবায়ুজনিত ধাক্কায় কতটা ভঙ্গুর।

এলএনজির দাম বৈশ্বিক বাজারে অতি অস্থির। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে এলএনজির দর বেড়েছিল প্রায় তিনগুণ। এলএনজির দাম কিছুটা হ্রাস পেলেও (২০৩০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতি এমবিটিইউ প্রায় ৭ দশমিক ৫ ডলারে নামবে বলে পূর্বাভাস, যা বর্তমান দামের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম) বাংলাদেশ সেই সুযোগ পুরোপুরি নিতে পারবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইইএ। কারণ দেশের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত গ্যাস সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং অর্থায়নের সংকট নতুন করে আমদানি বাড়াতে বাধা সৃষ্টি করছে।

কারণ, দেশের অবকাঠামো এখনও দুর্বল। সংরক্ষণ ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর (রিগ্যাসিফিকেশন) করার সক্ষমতা সীমিত। এলএনজি টার্মিনাল দুটি সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত, যা জলবায়ু বিপর্যয়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার ওপর রয়েছে বিদেশি ঋণের চাপÑযার কারণে নতুন টার্মিনাল বা স্টোরেজ নির্মাণে অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ধীরগতির বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎসÑবিশেষ করে সৌর ও বায়ুশক্তি  থেকে উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্তমানে সে অনুপাতে কাজের অগ্রগতি নেই। বর্তমানে সৌর ও বায়ুশক্তি মিলিয়ে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম আসে।

আইইএ মনে করে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানো গেলে শুধু অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতাই বাড়বে না, একই সঙ্গে বায়ু মানও উন্নত হবে। সংস্থাটি বলেছে, জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পরিবেশ রক্ষায় একসঙ্গে এগোতে পারবে।

প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি বাংলাদেশ তার জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য না আনে, তবে বছরে জ্বালানি আমদানি ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

আইইএ  বলেছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তানির্ভর করছে শুধু জ্বালানির ধরন নির্বাচনের ওপর নয়, বরং জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা এবং উন্নয়ন ও টেকসইতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ওপর।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংস্থাটি বলেছে, দেশের জ্বালানি নীতিতে কাঠামোগত সংস্কার না আনলে এবং নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগ না বাড়ালে আগামী দশকে এলএনজি নির্ভরতা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতি ও পরিবেশ উভয়কেই সংকটে ফেলতে পারে।