মো. মাঈন উদ্দীন : এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে ভাবতে হবে। অর্থনীতিতে শিল্প উৎপাদক, ওষুধ খাত ও কৃষি খাতের বৈচিত্র্য আনতে হবে। উদ্যোক্তাদের নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করা উচিত। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ছয় বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ।
গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শনও করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তারা অন্য কথা বলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল, এটা মাথায় রেখে আমাদের রেখে কাজ করতে হবে।’ ইতোমধ্যে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর আবেদন করেছে কয়েকটি দেশ। সলোমন দ্বীপপুঞ্জ দেশটি গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় চেয়ে সিডিপির কাছে আবেদন করে। আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলা এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদন করে। মিয়ানমার নিজে চেয়েছিল এলডিসি থেকে বের হতে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে সিডিপি (কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি) ২০২৭ সাল পর্যন্ত দেশটির এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয়। এ ছাড়া সুনামির কারণে মালদ্বীপ এবং ভূমিকম্পের কারণে নেপালের এলডিসি উত্তরণ নির্ধারিত সময়ে হয়নি। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। এতে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, প্রবাসী আয়ও বেড়েছে। কারও কারও মতে বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এখন এলডিসি উত্তরণের সময় পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটাও এখন প্রশ্ন। তবে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে সংস্কার, বিনিয়োগ পরিবেশসহ কিছু খাতে এখনো দুর্বলতা রয়েছে। সম্প্রতি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ হয়েছে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে কোনো কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন অর্থনীতিতে নতুন সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় তারা এলডিসি থেকে উত্তরণে আরও সময় নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ, এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সে হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় রয়েছে ১৫ মাস। এলডিসি থেকে উত্তরণ বিষয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান জানাতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চিন্তাভাবনা করছি। তবে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হবে। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিলে প্রস্তুতি নিতে ভালো হয়। না হলে ব্যবসায়ীরা সব সময় বলে, প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি।’
উত্তরণ থেকে পেছানোর জন্য জাতিসংঘে কোনো আবেদন করা হবে কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পেছাতে এখনই আমরা আবেদন করব না। এটি নির্ভর করবে প্রস্তুতির ওপর। বাংলাদেশ থেকে পোশাক, ওষুধসহ বেশ কিছু পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ তিন থেকে ছয় বছর পেছানোর দাবি করেন। তারা বলেন, উত্তরণের পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে সফটওয়্যার ও বইসহ বিভিন্ন পণ্যের কপিরাইট ইস্যুতে বাড়তি টাকা খরচ হতে পারে। এছাড়া জিএসপিসহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচকের ভিত্তিতে এলডিসি উত্তরণ করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যদি কোনো দেশ দ্বিতীয় পর্যালোচনার পর এসব সূচকে পিছিয়ে যায়, তাহলে উত্তরণ পিছিয়ে দেয় জাতিসংঘ। তবে বাংলাদেশ তো এখনও তিনটি সূচকেই ভালো অবস্থায় রয়েছে। জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, সরকারপ্রধানকে সরাসরি ইকোসকের সিডিপির প্রধানের কাছে চিঠি লিখতে হবে। চিঠিতে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে যে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মানমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা রাখতে পারেন। একটি দেশের সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণিতে আছে, এর ওপর।
অন্যদিকে এলডিসি তালিকায় থাকলে ওই দেশকে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় উন্নত দেশগুলো। এটি অনেকটা পরনির্ভরশীলতায় থাকার মতো বিষয়।
ব্যাংকার, মুক্ত লেখক
main706@gmail.com