নিজস্ব প্রতিবেদক : উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) সময় বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও নিজ নিজ জায়গা থেকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। গতকাল শনিবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এত অল্প সময়ে শুধু সরকারের পক্ষে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সময় বাড়ানো অসম্ভব প্রায়। আপনারা (ব্যবসায়ীরা) আপনাদের জায়গা থেকে বায়ারদের মাধ্যমে আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। শুধু ইউকে কিংবা কয়েকটি দেশে সমর্থন দিয়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন থামানো সম্ভব নয়। বায়ারদের মাধ্যমে তাদের দেশের সরকারের সমর্থন আনতে আপনাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পথে বাংলাদেশ, নেপাল ও লাওস থেকে ভালো অবস্থানে আছে। এখন কোনো ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে না। এই দুই দেশ যদি গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর আবেদন করে, তাহলে বাংলাদেশও আবেদন করতে পারবে। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। ব্যবসায়ীদের নিজ উদ্যোগে প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে সময় বাড়াতে উচ্চ মানের লবিং করতে হবে। এটি ছাড়া এত অল্প সময়ের উদ্যোগে কোনোভাবেই সময় বাড়ানো সম্ভব হবে না।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পরিচয় বহন না করে তিনি ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া) ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তখন তিনি বলেন, ‘আমি আজ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে আসিনি। একজন গবেষক হিসেবে আমার গবেষণা তুলে ধরতে এসেছি। আমার দীর্ঘদিনের একটা সার্ভে আমি তুলে ধরব।’
ওই সার্ভেতে আনিসুজ্জামান চৌধুরী দেখান, বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য নেপাল, লাওসসহ অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বিগত সরকারের সময়ে অনেক ভুয়া ও ম্যানিপুলেটেড তথ্য দিয়ে এই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এখন দেশের অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে রপ্তানি জট দূর হয়েছে, ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং মূল্যায়ন শুরু হয়েছে, বন্ডেড সুবিধা, এগ্রিকালচারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমরা যে অবস্থায় আছি তা অনেক দেশের তুলনায় ভালো।’
কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জিম্বাবুয়েকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘অতীতে অর্থনৈতিকভাবে এই দেশগুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়েছিল। কিন্তু তারা এলডিসি সুযোগ না নিয়ে নিজেরাই সফল হয়েছে। বাংলাদেশও চ্যালেঞ্জ নিলে সফল হতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।’
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নেয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যখনই আপনি ঝুঁকি নেবেন, তখনই আপনি বড় কিছু করতে পারবেন। তবে গ্র্যাজুয়েশন হতে খুব বড় কোনো ঝুঁকি কিংবা ক্ষতি হবে বলে আমাদের মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘২০০৫ সালে আমরা ঝুঁকি নিলাম। তখন আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে বড় প্রবৃদ্ধি এসেছিল। আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন অ্যাভারেজ ১০০ ডলার, যা ২০০৮ সালেও একই ছিল। অথচ ভিয়েতনাম আমাদের কাছাকাছি একটা অর্থনীতির দেশ হয়ে কর্মীদের ২০৮ ডলার দিয়েও ভালো করছে। আমরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েও কেন পিছিয়ে থাকব। তাই ব্যবসায়ীদের অবশ্যই ঝুঁকি নিতে শিখতে হবে।’
বিকেএমইএ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ভুল তথ্য-উপাত্ত ও ম্যানিপুলেটেড তথ্য দিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে বিগত সরকারের সময়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আমি আগেই এ বিষয়গুলো বলে আসছিলাম। এই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্ত এসেছে, যা আমাদের ব্যবসায়ীদের ঝুঁকিতে ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে ভালো অবস্থায় নিতে কাজ করছে। আমাদের এখন সরকারকে সময় দিতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ৮টি দেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হয়েছে। তাদের রপ্তানি বাজার অতটা বড় না হওয়ায় এটি সহজ হয়েছে। তবে আমাদের রপ্তানি বাজার অনেক বড়, এখানেই আমাদের ঝুঁকি। গ্র্যাজুয়েশন হলে আমাদের রপ্তানি বাজারে বড় ধাক্কা লাগতে পারে।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তীতে কী কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। আমাদের সঙ্গে বসেই ঠিক করতে হবে কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরেরও বেশি সময়ে এটি নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসেনি। আমাদের কাস্টমসে অনেক সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধান করলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পথ সহজ হবে বলে মনে করছি।’
সেমিনারে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হতে হবে, তার বিকল্প নেই। তবে কখন গ্র্যাজুয়েশন হতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও প্রাইভেট সেক্টরকে বসেই সময় ঠিক করতে হবে। গ্র্যাজুয়েশন হলে সমস্যা কী হবে, তা নিয়েও আলোচনা করতে হবে।’
নেপাল ও লাওসের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রপ্তানি বাজার বিশ্লেষণে আমাদের বাজার তুলনামূলকভাবে অনেক বড়, নেপাল ও লাওস সেখানে অনেক পিছিয়ে আছে। তাই নেপাল ও লাওসের গ্র্যাজুয়েশন সহজ হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি কঠিন।’
মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, ‘আমাদের জ্বালানি সংকট দূর করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিলেও এটির তেমন অগ্রগতি হয়নি। কাস্টমসে অনেক সমস্যা আছে। এগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে আমাদের শুল্কহার ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।’
বাপির সিইও মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ওষুধ উৎপাদন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে, তারা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে থাকবে না। কারণ, তারা তো এত বেশি শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে এখানে উৎপাদন করবে না। এ ছাড়া ওই কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে ওষুধ উৎপাদন না করলে অনেক ওষুধই বাংলাদেশের মানুষকে বেশি দামে কিনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গ্র্যাজুয়েশন হতে আমাদের সেক্টরে যে ধরনের দক্ষ জনবল থাকা দরকার, সেটি আমাদের নেই। আমাদের গবেষণা খাত অনেক পিছিয়ে আছে। রিসার্চ না বাড়ালে আমাদের ওষুধের রপ্তানি বাজার খুব বেশি সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। সরকারের উচিত এই গবেষণার প্রতি জোর দেয়া। পাশাপাশি আরও কিছুটা সময় নিয়েই গ্র্যাজুয়েশন হওয়া দরকার।’
বিজিএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান বলেন, ‘আমরা গ্র্যাজুয়েশন হতে চাই। তবে এটি আরও অন্তত তিন বছরের জন্য সময় নিয়ে হতে চাচ্ছি। আমরা রপ্তানিকারকরা এ মুহূর্তে গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নই। আমরা রপ্তানি বাজারে একবার নিজেদের অবস্থান থেকে নেমে গেলে সেখান থেকে ব্যাক করাটা অনেক চ্যালেঞ্জ হবে। তাই আমাদের তিন বছর সময় দেয়া হলে আমরা এই চ্যালেঞ্জটা মোকাবিলা করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে। ইউরোপের বাজারেও এখন অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও কার্বন সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে। যেটি বাধ্যতামূলক হতে যাচ্ছে। আমরা যদি ২০২১ সাল থেকে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারতাম, তাহলে গ্র্যাজুয়েশন হওয়াটা আমাদের জন্য সহজ হতো। আগের সরকার সেই প্রস্তুতি নিতে আমাদের শক্তিশালী হওয়ার পরামর্শ দেয়নি।’
এনামুল হক খান আরও বলেন, ‘ইইউ আমাদের ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকতে সমস্যা হবে। এই ভর্তুকিটা ২০২৩ সাল থেকে কমে আসছে। গ্র্যাজুয়েশন হলে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, তখন ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারবে না। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এটিও আমাদের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তি করতে হবে। এটা গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তীতে টিকে থাকতে সহায়তা করবে। আমাদের বন্দরগুলো উন্নত করতে হবে। বে-টার্মিনালগুলোকে সচল করতে হবে। মোংলা পোর্টের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। আমাদের কর্মীদের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তীতে আমাদের সক্ষমতা বাড়াবে। এক্ষেত্রে সরকারকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

Discussion about this post