আনোয়ার হোসাইন সোহেল : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের কোম্পানি অ্যাডভান্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (এসিআই) পিএলসির শেয়ারদর হঠাৎ কারণ ছাড়াই কমেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দর ২ টাকা ৬০ পয়সা কমে লেনদেন হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দিনের শুরুতে প্রতিটি শেয়ার ১৭৮ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হলেও ধীরে ধীরে চাপ বাড়তে থাকে। দিন শেষে শেয়ারদর কমে দাঁড়ায় ১৭৬ টাকা ২০ পয়সায়। ফলে দিনের ব্যবধানে প্রতি শেয়ারদর কমেছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। এদিন এসিআই পিএলসির মোট ৪৩ হাজার ৫৬৩টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৭৭ লাখ টাকা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, লভ্যাংশ নীতিমালায় পরিবর্তন আনা এবং আর্থিক চাপের কারণে এই কোম্পানির ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১৬ সাল থেকে এসিআই নিয়মিতভাবে ৫০ থেকে ১১০ শতাংশের বেশি নগদ লভ্যাংশ দিলেও ২০২৩ সাল থেকে কোম্পানিটির লভ্যাংশে বড় ধরনের পতন দেখা যায়।
বিশেষ করে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ক্যাশ ডিভিডেন্ড ৫০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। যদিও কোম্পানিটি বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশ বোনাস (স্টক ডিভিডেন্ড) ঘোষণা করেছে। ক্যাশ ডিভিডেন্ড কম থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে কোম্পানি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত বুধবার আমাদের কোম্পানির রেকর্ড ডেট ছিল। সেখানে আমরা ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছি।’
ঋণ–সম্পর্কিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এসিআইর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৯৪ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। একই সময়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণ আরও বেশি, ৫ হাজার ৬৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বিশাল ঋণ পোর্টফোলিও কোম্পানিটির আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে বলে বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তবে আর্থিক কর্মদক্ষতার দিক থেকে কোম্পানিটি আগের বছরের তুলনায় উন্নতির ইঙ্গিতও দিচ্ছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) ছিল ২৮২ টাকা ৯৯ পয়সা, যা চলতি বছরে বেড়ে হয়েছে ৩১৮ টাকা ৪২ পয়সা। অন্যদিকে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৭ টাকা ২৬ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ২৬ টাকা ১৮ পয়সা।
ডিএসইর দেয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য বেড়ে হয়েছে ৩৬১ টাকা ০৫ পয়সা, যা গত ৩০ জুন ছিল ৩৩৯ টাকা ৩১ পয়সা। এ সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ২০ টাকা ৮৯ পয়সা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৮ টাকা ৩২ পয়সায়।
বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার মালিকানায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ ১৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৪৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দখলে রয়েছে ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার।
১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের এই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে স্থিতিশীল অবস্থান ধরে রাখলেও ডিভিডেন্ড কমে আসা ও উচ্চ ঋণভার সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদরে চাপ তৈরি করছে বলে বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা। তিনি দেশের কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার একজন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। দেশের যে কয়েকজন উদ্যোক্তা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিনির্ভর না রেখে করপোরেটে রূপ দিয়েছেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছেন, সুপরিচিত দেশীয় ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন, তাদের মধ্যে একজন আনিস উদ দৌলা।
এসিআই এখন বছরে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লেনদেন বা টার্নওভারের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এর অধীনে কোম্পানি আছে প্রায় ২৫টি। ওষুধ, কৃষি, অটোমোবাইল, ভোগ্যপণ্য, স্বপ্ন সুপারস্টোর মিলিয়ে বহু খাতে তাদের ব্যবসা। অনেক পণ্যের বাজারেই তারা শীর্ষস্থানীয়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কোম্পানিটি ২০২৪–২৫ হিসাববছরে ৬৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এর আগের দুই বছরেও এসিআই লোকসানে ছিল। ২০২৩–২৪ হিসাব বছরে কোম্পানির লোকসান ছিল ১৩৯ কোটি টাকা। এর আগের হিসাববছরে ছিল ৪৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধিকে গত হিসাববছরে লোকসানের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এসিআই। এরপরও গত অক্টোবরে ৫ লাখ শেয়ার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে বিদ্যমান বাজারমূল্যে ব্লক মার্কেট থেকে ওই পরিমাণ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন তিনি।
