ড. মতিউর রহমান : বাংলাদেশ দ্রুত পরিবর্তনশীল এক দেশ, যেখানে শহরগুলোর প্রসারণ ঘটছে, গ্রামীণ জীবন নতুন রূপ নিচ্ছে এবং প্রযুক্তি প্রতিটি কোণকে সংযুক্ত করছে। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিশ্ববাজার এখন আর কোনো দূরের ধারণা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবুও এই পরিবর্তনের মাঝে বহু বাংলাদেশি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে, তারা আধুনিক জীবনধারা, ভোগবাদ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
পুরাতন ও নতুনের, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এই জটিল মিশ্রণকে বিশিষ্ট পণ্ডিত ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ‘ককটেল মতবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি এমন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা যেখানে ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো আধুনিক, প্রায়শই বস্তুবাদী, প্রলোভনের সঙ্গে সহাবস্থান করে। এই দুটি মাত্রা খুব কমই নির্বিঘ্নে মিশে যেতে পারে; বরং প্রায়শই তা উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বের জš§ দেয়। বয়স্ক প্রজš§ এবং বহু নারী পরিবার, নৈতিকতা ও সম্প্র্রদায়ের নিয়মকানুনকে অগ্রাধিকার দিতে থাকে, অন্যদিকে তরুণ প্রজš§ ক্রমে গতি, ব্যক্তিগত স্টাইল ও স্বাধীনতার প্রতি ঝুঁকছে। এই দ্বৈত ধারা বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবন, জনসংস্কৃতি, রাজনীতি এবং উন্নয়নকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
সিদ্দিকী এই ধারণাটি প্রথম আলোচনা করেন তার বই ‘জগৎপুর ১৯৭৭-১৯৯৭: গ্রামীণ বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও সামাজিক পরিবর্তন’-এ, যা ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি তার গভীর মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় লক্ষ্য করেন যে, বিশেষত দরিদ্র সম্প্র্রদায়গুলো এই দ্বৈত প্রভাব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়, এবং প্রায়ই নৈতিক শিক্ষা ও চাকচিক্যপূর্ণ আধুনিক ভোগবাদের প্রলোভনের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বের প্রকাশ বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে দৃশ্যমান।
উদাহরণস্বরূপ, একটি পরিবারে যেখানে বাবা-মা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের আধুনিক জীবনধারা প্রদর্শন করেন, সেখানেও কন্যাদের জন্য কঠোর নিয়ম আরোপ করা হতে পারে। একজন ব্যবসায়ী আক্রমণাত্মক ও বস্তুবাদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে পারেন, অথচ একইসঙ্গে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উদারভাবে দান করেন। তরুণরা নিয়মিত নামাজ বা প্রার্থনা করতে পারে এবং বয়স্কদের সম্মান করতে পারে, তবুও তারা বৈশ্বিক পপ সংস্কৃতির প্রবণতা অনুসরণ করে এবং শহুরে বিনোদন উপভোগ করে। এই আচরণগুলোর কোনোটিই পুরোপুরি ‘ঐতিহ্যবাহী’ বা ‘আধুনিক’ বিভাগে মানানসই নয়; বরং তারা একটি গতিশীল এবং প্রায়শই অস্বস্তিকর ভারসাম্যের মধ্যে সহাবস্থান করে। সিদ্দিকীর উদ্দেশ্য ছিল কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সমালোচনা করা নয়, বরং এটি দেখানো যে এই ধরনের উত্তেজনা সমাজের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি, নাগরিক সম্পৃক্ততা এবং টেকসই উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে, যখন ঐতিহ্য অথবা আধুনিকতা কোনোটিই সামাজিক অগ্রগতিকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে না।
এই ককটেল মতবাদ কেবল ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজের বৃহত্তর কাঠামোয়ও প্রতিফলিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে, আবার একইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক নীতির কথা বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চায়। এই দ্বিমুখী নীতি দেশের উন্নয়নে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায়ই কোনো সুসঙ্গত আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এই দ্বন্দ্ব দেখা যায়। একদিকে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা, যা গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, নৈতিকতা এবং মুখস্থ করার ওপর জোর দেয়, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, যা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রায়শই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে এবং তাদের মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট আদর্শের প্রতি দৃঢ় আস্থা গড়ে ওঠে না।
এই ককটেলের শিকড় বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে নিহিত। ১৯৬০-এর দশক থেকে, বাংলাদেশ দ্রুত নগরায়ণ, অভিবাসন এবং মিডিয়ার বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর দেশটি সামরিক ও বেসামরিক শাসন, বাজার সংস্কার এবং এনজিও ও পোশাক শিল্পের মতো নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর উত্থান দেখেছে। আধুনিক পণ্য ও ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বৈষম্য প্রায়শই ধর্ম এবং ঐতিহ্যের ওপর দৃঢ় আধিপত্যকে উৎসাহিত করেছে। এর ফলস্বরূপ এমন একটি সমাজ তৈরি হয়েছে, যেখানে আধুনিকতা প্রায়ই কেবল উপরিভাগের ভোগবাদে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ঐতিহ্য কখনও কখনও সংকীর্ণ গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে।
সিদ্দিকী তার মাঠ পর্যায়ের গবেষণা এবং নীতি অধ্যয়নে এই গতিশীলতাগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং দেখিয়েছেন কীভাবে এগুলো সামাজিক কাঠামো, প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। আর্থ-সামাজিক অবস্থা এই মিশ্রণের প্রভাবকে আরও তীব্র করে তোলে। সিদ্দিকী যুক্তি দিয়েছিলেন যে দরিদ্র সম্প্র্রদায়গুলো বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তারা কার্যকরভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ছাড়াই পরস্পরবিরোধী বার্তা পায়। তাদের বলা হয় যে আনুগত্য ও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা ভালো, অথচ একইসঙ্গে তারা দ্রুত সম্পদ ও আধুনিক আনন্দের প্রলোভনের মুখোমুখি হয়। শিক্ষা, নাগরিক জ্ঞান বা ন্যায্য প্রতিষ্ঠানের সুযোগ না থাকায়, এই মিশ্রণ তাদের ক্ষমতায়নকে বাধা দেয় এবং নির্ভরশীলতার চক্রে আটকে রাখে। সিদ্দিকীর গ্রাম অধ্যয়ন, বিশেষ করে জগৎপুরে, তিনি যাকে আদর্শিক হস্তক্ষেপ বলেছিলেন তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এর মধ্যে ছিল প্রগতিশীল শিক্ষা প্রচার করা, নাগরিক ও আইনি সাক্ষরতা শেখানো এবং আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে ঐতিহ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কমিউনিটি সংগঠন গড়ে তোলা।
এই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ককটেল মতবাদকে আরও জটিল করে তোলে। সমাজে একদল মানুষ আধুনিকতার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, অন্যদিকে আরেক দল মানুষ ঐতিহ্যের কঠোর নিয়মকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বিভাজন সমাজে শ্রেণি বৈষম্য বাড়ায় এবং সংঘাতের জš§ দেয়। ধনী পরিবারের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং ভোগবাদের সঙ্গে বড় হয়, যা তাদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা হয়তো আধুনিকতার স্বাদ পায় না, বরং তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের কঠোর প্রভাব থাকে। এই ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো সমাজে দুই ধরনের মনস্তত্ত্ব তৈরি করে, যা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব সৃষ্টি করে।
প্রজš§গত পার্থক্য এই ককটেল মতবাদে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা ধৈর্য, কর্তব্য এবং সম্প্র্রদায়ের সম্প্রীতিকে মূল্য দেন। তারা প্রায়ই আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক নির্দেশনা এবং সামাজিক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেন। তরুণরা, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, গতি, স্টাইল এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সন্ধানে বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ডিজিটাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উত্তেজনা প্রায়শই বাড়ি, স্কুল, কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনুভূত হয়। শিক্ষা, কর্মজীবন, বিবাহ এবং লিঙ্গ ভূমিকা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, যা জনজীবনেও ছড়িয়ে পড়ে।
নগরায়ণ এই ককটেল মতবাদে আরও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে আসা অভিবাসীরা ঢাকার দ্রুত বর্ধনশীল বস্তিগুলোতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। তাদের কাজ প্রায়শই অনানুষ্ঠানিক, অস্থায়ী এবং দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপন এমন উচ্চাকাক্সক্ষী জীবনধারা তৈরি করে, যা খুব কম লোকই সম্পূর্ণরূপে অর্জন করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অনেকে ধার্মিকতাকে বাস্তববাদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন ধর্মীয় কর্তব্য পালনের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কে কাজ করেন, যেখানে ছোটখাটো দুর্নীতি বা আপস জড়িত থাকতে পারে। সিদ্দিকীর নগর সামাজিক রূপ নিয়ে গবেষণা দেখায় যে কীভাবে শ্রেণি, অভিবাসন এবং গণমাধ্যমের প্রভাব এই ককটেলকে রূপ দেয়।
লিঙ্গগত গতিশীলতা এই মতবাদ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের প্রায়শই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ বজায় রাখার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখার প্রত্যাশা করা হয়। পোশাক শিল্প, সেবা খাত এবং ছোট ব্যবসায় নারীরা পারিবারিক আয় এবং সামাজিক প্রত্যাশা পুনর্গঠন করে, যা পরিবারে উদ্বেগ, আলোচনা এবং প্রতিরোধের জš§ দেয়। ককটেল মতবাদ এই উত্তেজনাকে ধারণ করে: নারীরা ঐতিহ্যের প্রতীক এবং আধুনিকতার প্রতিনিধি, একটি দ্বৈত ভূমিকা যা চাপ সৃষ্টি করলেও পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তৈরি করে। টেকসই সামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সুসংহত নিয়ম: নিরাপদ কাজ, সমান সুযোগ, সম্মান এবং বাড়ি ও সম্প্রদায় উভয় ক্ষেত্রেই একটি প্রকৃত কণ্ঠস্বর।
গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি এই মূল্যবোধের মিশ্রণকে আরও গতিশীল করে তুলেছে। সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো একইসঙ্গে ধর্মীয় ধর্মোপদেশ, অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা, সেলিব্রিটিদের গসিপ এবং বৈশ্বিক বিনোদন সরবরাহ করে। ডিজিটাল অর্থায়ন, অনলাইন শপিং এবং টেলিযোগাযোগ এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও আধুনিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ভাইরাল প্রবণতাগুলো সামাজিক বিতর্ককে বাড়িয়ে তোলে, যা কখনও কখনও মেরুকরণের চাপ তৈরি করে। একইসঙ্গে এসব মাধ্যম দাতব্য উদ্যোগ, যুব আন্দোলন এবং দুর্যোগ মোকাবিলার মতো ইতিবাচক কাজকেও সমর্থন করে।
ককটেল মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই গতিশীলতাকে বোঝা গেলে এটা স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশ কেবল ধর্মনিরপেক্ষ বা আরও বেশি ধর্মীয় হয়ে উঠছে নাÑ বরং এটি একটি মিশ্রণের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করছে, যা প্রতিনিয়ত বিকশিত ও পুনর্গঠিত হচ্ছে। ককটেল মতবাদের ধারণাটি বাংলাদেশের কিছু পুনরাবৃত্ত নীতিগত ধাঁধাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলো প্রায়ই ব্যর্থ হয় কারণ নাগরিকরা অনানুষ্ঠানিক শর্টকাট ব্যবহারে অভ্যস্ত। নাগরিক দায়িত্ব জোরদার না করে যদি কেবল ঐতিহ্যবাহী আনুগত্য ও আধুনিক ভোগবাদ পাশাপাশি চলে। তবে ব্যয়বহুল শিক্ষা উদ্যোগও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন তরুণকে দেখা যায়, যিনি একদিকে ধর্মীয় পোস্ট শেয়ার করছেন এবং অন্যদিকে আধুনিক ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন। এই দ্বৈত আচরণ বাহ্যিকভাবে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও, ককটেল মতবাদের আলোকে তা স্বাভাবিক। কারণ ব্যক্তিটি উভয় জগৎ থেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী উপাদান গ্রহণ করছে। ধর্মীয় পোস্ট তাকে নৈতিক সান্ত্বনা দিচ্ছে, আর আধুনিক লাইফস্টাইল তাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দিচ্ছে। এই মিশ্রণটি ব্যক্তির মনস্তত্ত্বে কোনো বড় ধরনের সংঘাত তৈরি করছে না, বরং একটি অদ্ভুত ভারসাম্য বজায় রাখছে।
একটি স্বাস্থ্যকর ককটেল সম্ভব। সিদ্দিকী অন্তর্ভুক্তিমূলক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ওপর জোর দেন যা বিজ্ঞান, যুক্তি, অধিকার এবং দায়িত্ব শেখায়। একইসঙ্গে তিনি ধর্মের একটি প্রগতিশীল ব্যাখ্যার পাশাপাশি নীতিশাস্ত্র, সমাজকল্যাণ এবং ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেন। শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা যখন একে অপরকে শক্তিশালী করে, তখন নৈতিকভাবে ভিত্তিযুক্ত এবং সমালোচনামূলকভাবে সচেতন নাগরিক তৈরি হয়। আইনি সচেতনতা কর্মসূচি, ভোটার শিক্ষা এবং ন্যায্য স্থানীয় ফোরামের মতো ব্যবহারিক সরঞ্জামগুলো নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে এবং অনানুষ্ঠানিক চাপ ও দুর্নীতির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে।
নীতিনির্ধারকদের জন্য শিক্ষাটি সুস্পষ্ট: আইন, প্রতিষ্ঠান এবং বার্তাগুলোকে সুসংগত মূল্যবোধ প্রতিফলিত করার জন্য সাজাতে হবে। যদি কর্মক্ষেত্রগুলো অনিরাপদ থাকে, অথবা ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পগুলো যদি নারীর ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত না করে পরিচালিত হয়, তবে শুধু পারিবারিক মূল্যবোধের প্রচার অকার্যকর। ধর্মীয় সংগঠনগুলো যদি ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির পক্ষে থাকে, তবে তারা সামাজিক অগ্রগতিকে সমর্থন করতে পারে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো কর্মীদের নিরাপত্তা, নৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বশীল উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে সততাকে এগিয়ে নিতে পারে। যখন ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখন মিশ্রণটি বিভ্রান্তি বা দ্বন্দ্বের উৎসের পরিবর্তে একটি ইতিবাচক, সমৃদ্ধ মিশ্রণে পরিণত হয়।
পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জন্য, এই ধারণাটি পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা এবং আত্মসমালোচনাকে উৎসাহিত করে। বাবা-মায়েরা ধৈর্য, শ্রদ্ধা এবং নৈতিক দায়িত্বের পাঠ ভাগ করে নিতে পারেন। অন্যদিকে শিশুরা কৌতূহল, উদ্ভাবন এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা নিয়ে আসতে পারে। সততা, সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মতো মূল মূল্যবোধগুলো সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় লেবেলের ঊর্ধ্বে থাকে। ধারাবাহিকভাবে এই মূল্যবোধগুলো চর্চা করা হলে একটি বিশৃঙ্খল মিশ্রণ থেকে স্থিতিস্থাপকতা এবং অগ্রগতির উৎসে পরিণত হওয়া সম্ভব।
ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকীর ‘ককটেল মতবাদ’ বাংলাদেশের জীবনের বাস্তবতাকে তুলে ধরে: ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, বিশ্বাস ও বস্তুগত আকাক্সক্ষা, পুরোনো নিয়ম ও তরুণ প্রজšে§র স্বাধীনতার মধ্যে চলমান এক নীরব সংলাপ। এটি দৈনন্দিন দ্বন্দ্ব, সামাজিক উত্তেজনা এবং নীতিগত চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যেখানে বিশ্বাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান এবং নাগরিক দায়িত্ব পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে। যদি বাংলাদেশ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি শিক্ষা, নীতিশাস্ত্র এবং ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করতে পারে, তাহলে ‘ককটেল’টি কেবল একটি রূপকের চেয়েও বেশি কিছু হতে পারে; এটি এমন একটি সমাজ গঠনের জন্য একটি দিকনির্দেশনা হতে পারে যা সমৃদ্ধ এবং ন্যায়সঙ্গত উভয়ই। ড. সিদ্দিকীর কাজ আজও যারা বাংলাদেশকে গভীরভাবে বুঝতে চান, তাদের জন্য অপরিহার্য।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

Discussion about this post