এস এম রুবেল, কক্সবাজার : কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভাঙন দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। সাম্প্র্রতিক সময়ে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভাঙন আরও বেড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গুপ্তখাল। এর ফলে সৈকত যেমন পর্যটকদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে, তেমনি হোটেল-মোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনাও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সমুদ্রবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ভবিষ্যতে এই ভাঙনের মাত্রা আরও বাড়বে। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তা বরং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। পাউবো কর্তৃক নির্মিত বালুভর্তি জিওব্যাগের বাঁধ সৈকতের এক পাশে দিলে অন্য পাশে দ্রুত ভাঙন দেখা দিচ্ছে। উপরন্তু এসব বাঁধ টেকসইও হচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সমুদ্রসৈকতের ভাঙন এখন একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা পর্যটন ও পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপ্রতুল উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভাঙনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সৈকতে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ এবং অব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া বাঁধ ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এ অবস্থায় স্থানীয়রা দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
গত এক দশকে কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিকবার ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। পাউবো চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জিওব্যাগ স্থাপন করলেও তা কার্যকর হয়নি। নতুন করে শুরু হওয়া ভাঙনে বিপুলসংখ্যক ঝাউগাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
সৈকতের লাবণী বিচ, নাজিরারটেক এবং মেরিন ড্রাইভ-সংলগ্ন বিভিন্ন অংশে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সাম্প্র্রতিক এক সপ্তাহে উত্তাল সমুদ্র ও জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে কয়েক হাজার ঝাউগাছ উপড়ে গেছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘গত ৫০ থেকে ৬০ বছরে বালিয়াড়িতে এমন ভাঙনের নজির নেই। পাউবোর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত জিওব্যাগের বাঁধের কারণে সৈকতের আরও বড় অংশ ভেঙে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ ও স্রোতের একটি স্বাভাবিক গতি আছেÑ এই গতিপথে বাধা এলে তা বিপর্যয় ডেকে আনে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতায় তীরে আছড়ে পড়ছে। প্রচণ্ড ঢেউয়ে অধিকাংশ জিওব্যাগ ছিঁড়ে গেছে। ব্যাগ ছিঁড়ে যাওয়ার পর একের পর এক ঝাউগাছ উপড়ে পড়ছে।
পাউবো কক্সবাজারের বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানান, ‘ভাঙনরোধে নাজিরারটেক থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঝাউবন ও বালিয়াড়ি রক্ষা পাবে।’
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত এক মাসে প্রায় আড়াই শত বড় ঝাউগাছ এবং কয়েক হাজার ছোট ঝাউ চারা উপড়ে গেছে। এটি সমুদ্রের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সৈকতের ভাঙন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দে র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বালুর বাঁধ দিয়ে সমুদ্র শাসন কিংবা ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ভাঙন বেশি হচ্ছে।’
১৯৬১-৬২ সালে বন বিভাগ সৈকতের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ১২ হেক্টর বালিয়াড়িতে প্রথম ঝাউগাছের চারা রোপণ করে। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঝাউবনের আয়তন বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজারের ডায়াবেটিক হাসপাতাল, লাবণী, কলাতলী, উখিয়ার ইনানী, সোনারপাড়া, টেকনাফের বাহারছড়া, মহেশখালীয়াপাড়া এবং সাবরাং উপকূলের প্রায় ৫০০ হেক্টর বালিয়াড়িতে প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার ঝাউগাছের চারা রোপণ করা হয়। গত ১০ বছরে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ৭ লাখের বেশি ঝাউগাছ।

Discussion about this post