হাসনাইন মামুন : তখন আমার অফিস মতিঝিলে। দিনটা বেশ ব্যস্ত কেটেছিল। কাজ শেষে রাতের দিকে মেট্রোতে উঠলাম। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৯টা ছুঁই ছুঁই। স্বাভাবিকের তুলনায় ট্রেনটা এ সময় বেশ ফাঁকা থাকে। জানালার বাইরে ঝলমলে আলো, ভেতরে ক্লান্ত মুখগুলো সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের নীরবতা।
তবে সেদিনের যাত্রা আলাদা হয়ে গেল। যাত্রীদের মুখ আর কথাবার্তা দেখে অনুমান করা কঠিন হলো না— এদের বেশির ভাগই ব্যাংক বা করপোরেট অফিসের মানুষ। সাধারণত আমি হেডফোন কানে দিয়ে নিজের জগতে ডুবে যাই। কিন্তু সেদিন কেন যেন হেডফোনটা ব্যাগেই রয়ে গেল। পাশেই দাঁড়ানো চারজন তরুণ-তরুণীর প্রাণবন্ত আলাপ কানে এলো।
তাদের আলোচনা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে নিজের অজান্তেই কান পাতলাম। টপিকটা একেবারে অফিসের ভেতরের চিরচেনা প্রমোশন, এইচআরের ভূমিকা, আর নেতৃত্বের পদ্ধতি।
মনে হচ্ছিল, যেন আমি এক অদৃশ্য সেমিনারে বসে আছি, যেখানে তরুণ পেশাজীবীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও ক্ষোভ তুলে ধরছে। আমি কিছু বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত নীরব শ্রোতাই হয়ে থাকলাম।
তাদের আলাপে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ছিল— ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা।
কারও পদোন্নতি হলো, কিন্তু কেন হলো পরিষ্কার নয়। আবার কোনো প্রজেক্ট নেয়া হলো, কিন্তু টিমকে বোঝানো হলো না। সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কার স্বার্থে হচ্ছে বা এর উদ্দেশ্য কী— সে ব্যাখ্যা নেই।
এই স্বচ্ছতার অভাব আসলে আমাদের কর্মজীবনে নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের ভেতরেই এর শিকড়। আমরা খুব কমই প্রশ্ন করি, খুব কমই ব্যাখ্যা দিই। অথচ কর্মজীবনে স্বচ্ছতা শুধু এইচআর বা ম্যানেজমেন্টের একার দায়িত্ব নয়— এটা প্রত্যেক কর্মীর নৈতিকতার অংশ।
যখন কোনো কাজের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে জানানো হয়, তখন শুধু দায়িত্ববোধই বাড়ে না, কাজের প্রতি এক ধরনের মালিকানাও তৈরি হয়। কর্মীরা বুঝতে পারেন, তাদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বিশ্বাস। তাদের কথায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এলো প্রফেশনালিজম বা পেশাদারত্ব।
আমরা অনেক সময় পেশাদারত্বকে কেবল দক্ষতা বা পারফরম্যান্সের সমার্থক মনে করি। কিন্তু বাস্তবে পেশাদারত্বের ভিত তৈরি হয় তিনটি স্তম্ভের ওপর: নৈতিকতা, সততা, আর স্বচ্ছতা।
একজন প্রকৃত নেতা শুধু কাজ ভালো করেন না— তিনি উদাহরণ তৈরি করেন। আর সেই উদাহরণই অন্যদের অনুপ্রাণিত করে।
যদি নেতৃত্ব কেবল কাজে দক্ষতাদর মাপকাঠিতে সীমাবদ্ধ হয়, তবে প্রতিষ্ঠান হয়তো টিকে যাবে, কিন্তু মানুষ গড়তে পারবে না। অথচ মানুষ গড়া ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদে এগোতে পারে না। তাদের একজন সুন্দরভাবে বলল ঠিক কাজটি করা, সঠিকভাবে কিছু করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা আমার মনের ভেতর গভীর রেখাপাত করল। শুধু ম্যানেজমেন্ট বা এইচআর নয়—একজন কর্মী হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরছিল।
তাদের আলোচনায় উত্তরও মিলল। কর্মজীবনের প্রথম শর্ত হলো সততা ও নৈতিকতা। এগুলো ছাড়া যতই দক্ষতা থাকুক না কেন, দীর্ঘমেয়াদে ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখা কঠিন।
এরপর আসে কাজের বিস্তৃতি আর জটিলতা। শুরুতে সহজ কাজ অনেকটা আরামের মতো মনে হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ফলপ্রসূ হয় না। বরং যে কর্মী বারবার নতুন দায়িত্ব নেয়, ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে সেখান থেকেই তার প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয়।
একজন কর্মী যত বেশি ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তত বেশি সে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হয়। নেতৃত্ব মানে শুধু নির্দেশ দেয়া নয়, বরং কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখানো।
তাদের আলোচনা শেষে গড়ালো বড় ছবির দিকে। যদি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা থাকে, পেশাদারত্ব থাকে, আর কর্মীরা সততা ও চ্যালেঞ্জ নেয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে—তাহলে তৈরি হয় একটি প্রগ্রেসিভ এনভায়রনমেন্ট বা উন্নত পরিবেশ।
এমন পরিবেশ কেবল প্রতিষ্ঠানের মুনাফার জন্য নয়, বরং প্রতিটি কর্মীর ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। একে অপরের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়। কাজ তখন আর কেবল চাকরি থাকে না, হয়ে ওঠে একধরনের যাত্রা।
ট্রেন যখন স্টেশন ছাড়ছিল, জানালার বাইরে শহরের আলো ফিকে হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই চার তরুণ-তরুণীর কথোপকথন আসলে আমাদের করপোরেট সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তাদের কথায় ক্ষোভও আছে, প্রত্যাশাও আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা একটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আছে।
আমাদের কর্মক্ষেত্র বদলাবে তখনই, যখন আমরা প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে স্বচ্ছতা ও সততার অনুশীলন শুরু করব। নেতৃত্ব তখনই সত্যিকারের নেতৃত্ব হবে, যখন তা উদাহরণ তৈরি করবে। আর কর্মীরা তখনই বেড়ে উঠবে, যখন তারা সাহসী হয়ে নতুন দায়িত্ব নেবে।
মেট্রোর সেই ছোট্ট যাত্রা আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমরা প্রতিদিনই এমন কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে যাই, কিন্তু সেগুলোতে লুকিয়ে থাকে আমাদের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের রূপরেখা।
স্বচ্ছতা, পেশাদারত্ব আর সততা— এগুলো যদি সত্যিকারের চর্চা হয়, তবে শুধু একটি কোম্পানি নয়, পুরো সমাজ এগিয়ে যাবে।
সেদিনের সেই আলাপের সারমর্ম এক বাক্যে বলা যায়: স্বচ্ছতা শুধু নীতি নয়, এটি উন্নতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি।
চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি
প্রিন্ট করুন









Discussion about this post