প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে করা মামলায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মোসাম্মৎ ইসমত আরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এই আদেশ দেন। সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে আদালতের এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন সুলতানা পারভীন। প্রথমে আদালতের কাঠগড়ায় না ওঠে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাংবাদিক আরিফের আইনজীবী বিষয়টি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরে তাকে কাঠগড়ায় নেয়া হয়। আসামিপক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফখরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী। বাদীপক্ষে আজিজুর রহমান দুলুসহ জেলা বারের বেশ কয়েকজন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন।
আদালত প্রথম দফায় প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনেন। পরে মুলতবি দিয়ে আবার দুপুর আড়াইটায় শুনানি শুরু হয়। উভয়পক্ষের শুনানি ও এজাহার পর্যালোচনা করে আদালত আসামি সুলতানা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদেশের কিছু পরই প্রিজনভ্যানে করে তাকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।
কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কার করে ডিসির নামে নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফকে তার বসতবাড়ি ও বসতঘরের গেট ভেঙে তুলে নিয়ে যান জেলা প্রশাসনের তিন ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ার উদ্দেশ্যে জেলা শহরের পূর্বপাশে ধরলা নদীর তীরে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে পেটানো হয়। এরপর মাদক রাখার অভিযোগ দেখিয়ে মধ্যরাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। এ নিয়ে সারাদেশে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ শুরু হলে একদিন পর ভুক্তভোগীকে জামিন দেয়া হয়।
জামিনে মুক্তি পেয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন ও তিন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অজ্ঞাত ৩০-৩৫ জনকে আসামি করে এজাহার দেন তিনি। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজাহারটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। চার্জশিটে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন, তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং এসএম রাহাতুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরপর জামিন নিতে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন সুলতানা পারভীন। অপর আসামিরা এখনও আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি।
সাংবাদিক আরিফ বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশের জেরে আমাকে বিনা অপরাধে মধ্যরাতে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়। ন্যায়বিচার পাবার আশায় দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছি। আজ প্রাথমিকভাবে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছি। প্রমাণ হয়েছে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আমি মনে করি, এটি দেশের সাংবাদিক সমাজ, আমার সহকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের জন্য স্বস্তির খবর। শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাব বলে বিশ্বাস করি। আর কেউ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিকসহ দেশের কোনো নাগরিকের ওপর বেআইনি পদক্ষেপ নিতে না পারে।’
বাদীর আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের জামিন নামঞ্জুরের আদেশে বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে আমরা সন্তুষ্ট। আদেশটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।’

Discussion about this post