সিংহ, কালীপ্রসন্ন (১৮৪০-১৮৭০) সংগঠক, সাংবাদিক, লেখক, সমাজকর্মী। কলকাতার এক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী পরিবারে তার জন্ম। তার পিতামহ শান্তিরাম সিংহ ছিলেন জোড়াসাঁকো জমিদারির দীউয়ান। তিনিই সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। অন্যান্য ধনী ও অভিজাত পরিবারের সন্তানদের মতো কালীপ্রসন্নও ইংরেজ শিক্ষক এবং দেশীয় খ্যাতনামা পণ্ডিতরে কাছে বাড়িতে শিক্ষালাভ করেন। খুব অল্প বয়সেই বহুগুণে গুণান্বিত কালীপ্রসন্নের বুদ্ধিমত্তা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’। এখানে সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে মিলিত হয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ উপস্থাপন ও আলোচনা করতেন। ওই সভা বিধবাবিবাহ এবং অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনের মতবা প্রচার করত। ঈশ্বরচন্দ্র ব্যিাসাগর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে বিধবা-পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের লক্ষ্যে বেঙ্গল কাউন্সিলে আবেদনপত্র পেশ করার জন্য কালীপ্রসন্ন তিন হাজারেরও বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে তিনি বিধবা-বিবাহকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে এক হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা নে। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের জন্য ওই সভা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণসংবর্ধনা (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১) জ্ঞাপন করে। নীলকরদের নিপীড়নমূলক আচরণ উদ্ঘাটনে অবদানের জন্য রেভারেন্ড জেমস লং-কেও তারা সংবর্ধিত করেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ (১৮৬০) নাটক অনুবাদের অভিযোগে জেমস লঙের এক মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হলে (২৪ জুলাই ১৮৬১) কালীপ্রসন্ন তা পরিশোধ করেন।
কালীপ্রসন্ন শিল্প ও সংস্কৃতির, বিশেষত নাট্যসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নাটক ও যাত্রার মাধ্যমে সামাজিক জ্ঞান বৃদ্ধির মানসে তিনি বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৬) প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় তিনি পর্যায়ক্রমে তিনটি সাময়িকী প্রকাশ করেন: বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা (১৮৫৫), সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা (১৮৫৬) এবং বিবিধার্থ সংগ্রহ। তিনি নিজ সম্পাদনায় কিছুদিন পরিদর্শক নামে একটি দৈনিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন।
সমসাময়িকরে মধ্যে কালীপ্রসন্ন শিল্পসংস্কৃতির একজন মহান পৃষ্ঠপোষক, বিধবাবিবাহের একনিষ্ঠ প্রবক্তা, অনন্য সাধারণ সমাজনীতিবি ও দেশপ্রেমিক সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাংলা গদ্যের উন্নয়নে হুতোম প্যাঁচার নকশা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। সতেরো খণ্ডে সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা গ্যানুবাদও তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। এটি বাংলা সাহিত্যেরও একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কালীপ্রসন্ন মাত্র ত্রিশ বছরের জীবনে তার এসব কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৮৭০ সালের ২৪ জুলাই তার মৃত্যু হয়। [সংগৃহীত]

Discussion about this post