Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 12:57 am

কিরগিজস্তান থেকে ফিরছেন প্রতারিত ১৮০ বাংলাদেশি

মনিরুল হক : উন্নত জীবনের আশায় ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভনে কিরগিজস্তান পাড়ি জমিয়েছিলন একদল বাংলাদেশি। জমানো টাকা বা জমি বিক্রির টাকায় হতে চেয়েছিলেন প্রবাসীকর্মী। তবে সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়, যখন জানতে পারেন পড়েছিলেন প্রতারক চক্রের ফাঁদে। কষ্টে অর্জিত টাকা খুইয়ে, পরিবারের কাছ থেকে দূরে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তারা। প্রতারণার শিকার হয়ে কিরগিজস্তান থেকে এমন ১৮০ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসছেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাদের নিয়ে একটি বিমান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা ছিল। তাদের পরিবারের সদস্যরা এ জন্য অপেক্ষায় ছিলেন বিমানবন্দরে।

জানা গেছে, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাতে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভনে কিরগিজস্তানে গিয়ে বাস্তবে চরম বিপদে পড়েন তারা। তবে চাকরি না পাওয়া দেশটি তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর গতকাল রাতে এই ১৮০ জন বাংলাদেশি দেশের উদ্দেশে কিরগিজস্তান থেকে রওনা দেন বলে জানা যায়।

এদিকে প্রতারণার শিকার ওই মানুষগুলোকে বিমানবন্দরে জরুরি সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। এ কাজে সমন্বয় করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানায়, প্রবাসে স্বপ্নপূরণের আশায় অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাচারকারীদের বানানো ভিডিও দেখে আকৃষ্ট হন। কেউ কেউ ইউরোপে যাওয়ার আশায়, আবার কেউ উচ্চ বেতনে গার্মেন্টসে চাকরির প্রলোভনে উজবেকিস্তান হয়ে কিরগিজস্তানে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারেন, সবই প্রতারণা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার আল-আমিন নয়ন জানান, ফ্লাইট ডিলে কারণে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১১টার পরিবর্তে মধ্যরাতে অবতরণ করবে।

এর আগেও একই ধরনের কৌশলে পাচারকারী চক্র বাংলাদেশিদের মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে বিপাকে ফেলেছে।

প্রবাসে চাকরির জন্য যেতে ইচ্ছুক এমন লোকদের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণার তথ্যই প্রায়ই সামনে আসছে। এর আগে একই কৌশলে পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে মুক্তিপণ আদায় করে। এভাবে অনেকে ভিটেমাটি বেচে দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, অনেকে মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় প্রাণ হারাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচারের এ চক্রগুলো বেশ সুসংগঠিত, তারা মূলত দেশের দরিদ্র ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। তাদের দেখানো লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন এই দরিদ্র মানুষগুলো।

এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে হাতকড়া ও পায়ে শিকল পরিয়ে আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। একটি বিশেষ ফ্লাইটে তাদের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়েছিল।

ফেরত আসা এসব বাংলাদেশির অনেকেই মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হয়ে দালালদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। জানা গেছে, তাদের অনেকে এজন্য জনপ্রতি ৩০ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। তবে বৈধ কাগজপত্র না থাকায় এবং অনেকের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

তাদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর প্রায় তিন ঘণ্টা ফ্লাইটটি রানওয়েতেই অবস্থান করে। রাত ২টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের শেকল ও হাতকড়া খোলা হয় এবং অ্যারাইভাল গেটে আনা হয়।

এ সময় বিমানবন্দরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ টিম, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকসহ কাউকে তাদের কাছে যেতে দেয়া হয়নি। এমনকি ছবি তুলতেও বাধা দেয়া হয়।

ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে ব্র্যাক। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে ফিরে আসা এসব অভিবাসীর বাড়ি পৌঁছাতে অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হয়েছে।

গত ২ আগস্টও একইভাবে একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজে করে ৩৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তখনও তাদের সবাইকে হাতকড়া ও শেকল পরানো হয়েছিল। চলতি বছর মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এমন ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে একইভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ও তাদের হাতকড়া ও শেকল পরিয়ে আনা হয়। তখন দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি ভারতীয় নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬২ শতাংশই বাণিজ্যিক ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল এসব তথ্য জানিয়েছেন।

এমন এক সময়ে এই তথ্য সামনে এলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছেন। ট্রাম্প আগেই আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে ভারত ‘সঠিক কাজটাই করবে’।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক বিমানে শতাধিক ভারতীয়কে ফেরত পাঠানো হয়। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তাদের মধ্যে কিছু মানুষকে শিকল পরানো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ছাত্র ভিসাসংক্রান্ত নীতিমালার হালনাগাদ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জয়সোয়াল। কারণ এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরিকল্পনা করেছেন, এমন ভারতীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।