আরিফুল ইসলাম রাফি : বাংলাদেশের নগর ও উপনগর এলাকায় গত এক দশকে দ্রুত বিস্তৃত একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে ‘কিশোর গ্যাং’। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহী এমনকি মফস্বলের ছোট ছোট শহরগুলোতেও এখন এদের তাণ্ডব দৃশ্যমান। মারামারি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন ও বিক্রি, ইভটিজিং প্রায় সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতিনিয়তই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে মানুষ খুন হওয়ার খবর চোখে পড়ছে। অথচ এরা সবাই সমাজের সেই শ্রেণির, যাদের বয়স এখনও ১৮-এর নিচে। কিন্তু তাদের হাতেই প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। যাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা, তাদের হাতে উঠে এসেছে রামদা, চাপাতি আর আগ্নেয়াস্ত্র।
এছাড়া অভিভাবকরা আতঙ্কে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নাজুক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমিত সক্ষমতা নিয়ে নাজেহাল। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাই এ সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার এবং যুবসমাজকে সহজলভ্য হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়ার প্রবণতাই কিশোরদের এমন বিপথগামী করে তুলছে।
কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের ইতিহাস: বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নতুন নয়। নব্বই দশকেও কিছু কিশোর দলবদ্ধ হয়ে অপরাধ করত। তবে ২০১০ সালের পর থেকে এদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কেবল রাজধানীতেই সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২৫০টির বেশি। প্রত্যেক গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা গড়ে ১৫ থেকে ৩০ জন। কিছু ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৫০ জনের বেশি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ ও বাড্ডা এলাকায় গ্যাং কালচারের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার, অক্সিজেন, বাকলিয়া, পাহাড়তলী এলাকায়ও এদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, স্কুলে অনুপস্থিত ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত। দিনের বেলায় ‘স্কুল টাইম’-এ এই কিশোররা যুক্ত হচ্ছে মাদক, পর্নোগ্রাফি, অনলাইন জুয়া, ছিনতাই ও সাইবার অপরাধে। অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ সবাই মিলে যেখানে একটি কিশোরকে সঠিক পথে ফেরানোর কথা, সেখানে রাজনীতির ছত্রছায়ায় তারা হয়ে উঠছে ছুরি-রড হাতে ‘গ্যাংস্টার’।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ: রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কিশোর গ্যাংগুলো এতটা আগ্রাসী হতে পারত না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের মদদেই এরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক শোডাউন, মিছিল-মিটিং, ভোটকেন্দ্র দখল ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে কিশোরদের ব্যবহার করা হয়। ফলে তাদের অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশও প্রায়ই নির্বিকার থাকে।
প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও আদালত থেকে সহজে জামিন পেয়ে যায়। ফলে অপরাধ করে শাস্তি পাওয়ার ভয় থাকে না। অনেকে আবার ছাড়া পেয়ে পুনরায় জড়িয়ে পড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। অনেক ক্ষেত্রে গ্যাং সদস্যদের মধ্যে অপরাধের জন্য ‘গুরুত্ব’ পাওয়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলে। রাজনৈতিক দলগুলোও এদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায়ই এদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিশোরদের এমনভাবে অপরাধে জড়ানো রাজনৈতিক ব্যবস্থার দায়, যা ক্ষমতা অর্জনের লড়াইয়ে ন্যূনতম নৈতিকতা বিসর্জন দেয়ারই প্রমাণ। তবে শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতাও কিশোরদের অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। বেকারত্ব, দরিদ্রতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, পরিবারে ভাঙন এবং সমাজে অপরাধের প্রতি এক ধরনের ‘নীরব প্রশ্রয়’—সবই এর জন্য দায়ী।
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের কিশোরদের মধ্যে আবার দেখা যায় অযাচিত স্বাধীনতা ও শাসনের অভাব। তাদের অনেকেই মাদক, দ্রুত অর্থ আয়ের লোভ বা বন্ধুদের দেখাদেখি গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ে। ইন্টারনেটে সহিংস ভিডিও, অশ্লীলতা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে উস্কে দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালালেও কার্যত তেমন অগ্রগতি নেই। ধরা পড়লেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসে। দেশে কার্যকর ও মানসম্মত কিশোর সংশোধনাগারের সংখ্যা হাতেগোনা। ফলে অপরাধী কিশোরদের পুনর্বাসনের সুযোগও প্রায় নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলে মাত্র তিনটি বড় কিশোর সংশোধনাগার রয়েছে, যেখানে জায়গার তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি শিশু-কিশোর রাখা হয়।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে করণীয়: রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতার স্বার্থে কিশোর গ্যাং তৈরি এবং এদের ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, সংশোধনাগারগুলোর মানোন্নয়ন ও সংখ্যা বাড়াতে হবে, বেকার কিশোরদের জীবনমুখী শিক্ষা এবং ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করার ব্যবস্থা করতে হবে, অভিভাবক ও স্কুল প্রশাসনকে আরও দায়ি়ত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, মাদক ও অস্ত্রের অবৈধ সরবরাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সমাজে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে।
সামাজিক দায়বদ্ধতাও জরুরি: এটা মনে রাখতে হবে, কিশোররা হঠাৎ করে অপরাধী হয় না। সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে তাদের এমন করে গড়ে তোলে। পরিবার, শিক্ষক, স্থানীয় নেতা, এমনকি সাধারণ মানুষও নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। যদি আমরা কিশোরদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হই, তাদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে হয়তো তারা সঠিক পথ বেছে নেবে।
কিশোর গ্যাং সমস্যাটি কেবল একটি আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। রাজনীতি যদি ক্ষমতার জন্য শিশুদের হাতিয়ার বানায়, সমাজ যদি তাদের দূরে ঠেলে দেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাই এখনই সময় দায়ি়ত্ববান হওয়ার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সঠিক নীতির মাধ্যমে এ ব্যাধি নিরাময় সম্ভব।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post