নিজস্ব প্রতিবেদক : গত বাজেট বক্তব্যে কৃষি খাতে ব্যবহƒত কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহারসহ উৎপাদনবান্ধব শিল্পনীতিতে গুরুত্ব দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু শুল্কনীতির কারণে দেশের শিল্পকারখানায় কৃষি ফসলের সুরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান কীটনাশক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ কীটনাশক উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামাল আমদানিতে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারকে শুল্ক দিতে হয় উদ্যোক্তাদের। আর আমদানিতে মাত্র পাঁচ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারকদের। ফলে দেশের শিল্পকারখানায় কীটনাশক উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতেই লাভবান হচ্ছেন আমদানিকারকরা, যা স্থানীয় শিল্পকারখানা নির্মাণের এতে নিম্নমানের ও ভেজাল কীটনাশকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষকরা। পাশাপাশি দেশীয় শিল্পকারখানায় সাশ্রয়ী মূল্যে কীটনাশক উৎপাদন করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের উদ্যোক্তারা।
এ কারণে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিমুখী স্থানীয় শিল্পের বিকাশে বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত সুবিধা চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বালাইনাশক উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএএমএ)। সম্প্রতি শুল্ক সুবিধা চেয়ে এনবিআরকে এই চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
এনবিআরকে দেয়া চিঠিতে বিএএমএ বলেছে, বিদেশ থেকে কীটনাশক, আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, বালাইনাশকের কাঁচামাল ও সহযোগী উপাদান আমদানিতে ৩১ থেকে ৫৮ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয় দেশীয় উৎপাদনকারীদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শুল্ক কর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। কিন্তু এসব কাঁচামাল দিয়ে প্রস্তুতকৃত ফিনিশড পণ্য (কীটনাশক) বিদেশ থেকে আমদানিতে আমদানিকারকরা মাত্র পাঁচ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে থাকেন, যা দেশীয় শিল্প গড়ার পরিপন্থি।
উপরোক্ত পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমালে কীটনাশক উৎপাদন খরচ কমবে, কৃষকরাও ন্যায্যমূল্যে ভেজালমুক্ত পণ্য কিনতে পারবে। পাশাপাশি বালাইনাশকের আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে কম খরচে উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব কীটনাশক রপ্তানি করা সম্ভব, যা রপ্তানিমুখী শিল্পের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
বিএএমএ মনে করে, এজন্য আমদানির বিকল্প, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলার জন্য দেশি কোম্পানির বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামাল ও সহযোগী উপাদানে শুল্ক রেয়াত সুবিধা দেয়া জরুরি।
বিএএমএ জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য অনুযায়ী বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এক লাখ টন বালাইনাশকের বাজার রয়েছে, যার প্রায় ৯৫ শতাংশ বাজারই আমদানিনির্ভর। আমদানিকারকরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ফিনিশড পণ্য আমদানি করছেন, সিন্ডিকেট চক্র না থাকলে এবং অতি মুনাফা বন্ধ হলে প্রকৃতপক্ষে সমপরিমাণ কীটনাশক আমদানি সম্ভব সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকায়। সেইসঙ্গে কাঁচামাল ও সহযোগী পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক তুলে নিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করলে একই পরিমাণ বালাইনাশক কৃষকের হাতে পৌঁছাতে ব্যয় হবে মাত্র তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ১ হাজার ৩৮০ আমদানিকারক রয়েছেন বালাইনাশকের জন্য। তবে এনবিআর জানিয়েছে, সর্বশেষ গত অর্থবছরে মাত্র ২১১ আমদানিকারক পণ্য আমদানি করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিতে সক্রিয় না থাকলেও শত শত আমদানিকারক বিভিন্নভাবে বালাইনাশক নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বাজারজাত করছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। মূলত বহুজাতিক ও স্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির আমদানি ফিনিশড পণ্যে আমদানি মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। তাদের মতে, দীর্ঘ ৫৪ বছর পরেও এ পণ্যগুলো এখনো বিদেশ থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করে আনতে হয় এবং ১০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়। বিদেশি কোম্পানির দখলে বাজার। কীটনাশকের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। দেখা যায়, আইনবহির্ভূতভাবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে দায়িত্বশীলরাই।
কীটনাশক উৎপাদকারীরা জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কৃষি খাতে ব্যবহƒত কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে কোন কারণে বাস্তবায়িত হয়নি তা বোধগম্য নয়। এটা সরকারের বিনিয়োগ ও শিল্পনীতিকে উপেক্ষা করছে এনবিআর। এতে একদিকে দেশীয় শিল্প বিকাশে বাধা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার গড়ে উঠছে।
বিএএমএ’র সভাপতি কৃষিবিদ কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামাল বা সহযোগী উপাদানগুলোর এইচএস কোডকে কাস্টমস প্রসিডিউর কোডের অন্তর্ভুক্ত করে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা দিলে এ খাতের বিকাশ ঘটবে। এতে আমদানি কমে আসবে। তিনি বলেন, বালাইনাশকের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা। হাতেগোনা কয়েকজন কীটনাশক আমদানি করে। বাকিরা ভাগবাটোয়ারা করে চলে। এরাই দেশে ভেজাল কীটনাশক বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ করেন।
কৃষি উপকরণের কাঁচামাল আমদানি ও ফিনিশড পণ্য আমদানিতে শুল্কবৈষম্য দীর্ঘদিনের জানিয়ে তিনি জানান, কাঁচামাল ও সহযোগী কাঁচামাল আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের। অথচ বিদেশ থেকে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ফিনিশড পণ্য আমদানি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি দেশে হাজার হাজার প্রকৌশলী রাস্তায় আন্দোলন করেছে। কারণ দেশে কর্মসংস্থান নেই। শিল্পনীতি করা হচ্ছে, অথচ দেশে বিনিয়োগ নেই। উৎপাদনবিমুখ নীতির কারণে শিল্প গড়ে উঠেছে না।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান বলেন, দেশে প্রায় আটশ’র বেশি কীটপতঙ্গ, ৮৩০-এর বেশি রোগজীবাণু ও ১৭০টি আগাছা চিহ্নিত হয়েছে। এই বালাই নিয়ন্ত্রণে পেস্টিসাইডের ব্যবহার জরুরি হলেও তা যেন কৃষকের জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হয়, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। তিনি বলেন, ফিনিশড পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাঁচামাল আমদানির শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে কৃষকের কাছে পেস্টিসাইডের দাম কমপক্ষে ৫৫ শতাংশ কমে যেত। পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের বিকাশ হতো, কর্মসংস্থান বাড়তো এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো।
উল্লেখ্য, চীন ও ভারতে আমদানিকৃত পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহারের পার্থক্য যথাক্রমে প্রায় ৪০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশের অধিক রাখা হয়েছে। ফলে ওই দেশে বালাইনাশক প্রায় ১০০ শতাংশ উৎপাদন হয়ে থাকে এবং পৃথিবীর প্রায় ৬৫ শতাংশ বালাইনাশক ওই দুই দেশ থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে।
অনুরূপভাবে বিদেশি কীটনাশক আমদানি নিরুৎসাহিত করতে দেশি কোম্পানির উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল ও সহযোগী উপাদান আমদানির শুল্কহার শূন্যকরণে আহ্বান জানান প্রস্তুতকারকরা।

Discussion about this post