দেশে ৫০ বছরে কীটনাশকের বার্ষিক ব্যবহার বেড়ে ৪০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২ সালে যেখানে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল চার হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। ধান, শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে এসব কীটনাশক ব্যবহƒত হয়। শুধু গত পাঁচ বছরেই দেশে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ। কীটনাশকের বর্তমান বাজারের আকার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার।
রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) মিলনায়তনে মঙ্গলবার ‘কীটনাশকের ঝুঁকি নিরসন’ শীর্ষক সেমিনারের উপস্থাপনায় এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। সেখানে আলোচকরা বলেছেন, সাংবাদিকদের প্রতিবেদনের কারণে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এখন কীটনাশক ব্যবহারের আগে তারা চিন্তা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা কীটনাশকের অযথা ব্যবহার কমিয়েছেন। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি।
কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার যে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগের কারণ, এটা কোনো নতুন খবর নয়। সেই ২০১৩ সালেই জাতিসংঘের স্টকহোম কনভেনশনে কৃষিতে ব্যবহƒত ১২টি রাসায়নিক দ্রব্যকে তালিকাভুক্ত করে তাকে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলা হয়েছে, এই রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর পর ভালো করে ধুলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। তাই কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রতিরোধ করতে হবে। কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ অংশীজনদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
সাধারণ কৃষক কীটনাশক প্রয়োগে নির্দেশনা জানেন না; যারা জানেন, তারা মানছেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলেছে, কীটনাশক ব্যবহারের পর অন্তত এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর শাকসবজি খাওয়ার উপযোগী হয়। কীটনাশকের গায়ে নির্দেশনাও লেখা থাকে। কিন্তু কে এসব মেনে চলে?
খাদ্য নিরাপত্তায় দেশের কৃষকদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। নানা প্রয়োজনে কৃষিজমি কমছে। অথচ কৃষক পাল্লা দিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছেন। উৎপাদন বাড়াতে তাদের কীটনাশকের ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে অনেক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তথ্যমতে, তারা বাজার থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করেছেন, তার ২৯ শতাংশেই কীটনাশকের অবশেষ পাওয়া যায়। তারা আরও বলেন, কীটনাশক থেকে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। বমি, চুলকানি ও মাথা ঝিমঝিম করার মতো রোগের পাশাপাশি ক্যানসার, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, অ্যাজমা, বন্ধ্যত্ব ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেসের মতো রোগও দেখা দেয়।
কীটনাশকের ব্যবহার পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য হলেও এটি মানবস্থাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে স্বাস্থ্যের বিষয়টিও দেখতে হবে। আমরা মনে করি, কৃষকদের কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে অধিদপ্তরের পাশাপাশি গণমাধ্যমের এগিয়ে আসা দরকার। কৃষিবিজ্ঞানীরা সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গণমাধ্যম, ভোক্তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ অংশীজনদের পরামর্শÑকীটনাশক কেনাবেচা ও প্রয়োগে টেকসই পদ্ধতির মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দিকগুলো এড়িয়ে চলার ব্যবস্থা নিতে হবে।