ড. মতিউর রহমান : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, এটি মানবসমাজের গঠন, জ্ঞান উৎপাদন, শ্রমবাজার ও সম্পর্কের ধরনকেও আমূল বদলে দিচ্ছে। এই প্রযুক্তি এমন এক গতিতে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করছে যে এর প্রভাব বোঝার জন্য প্রথাগত জ্ঞানচর্চার পদ্ধতিগুলো যথেষ্ট নয়। সমাজবিজ্ঞান, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ এবং তার পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করে, আজ এই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। এআই-এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব সমাজবিজ্ঞানকে এক নতুন সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছে, যেখানে তার কাজ হবে এআই কীভাবে সমাজের কাঠামো ও মূল্যবোধকে পুনর্গঠন করছে, তা বিশ্লেষণ করা এবং এ থেকে উদ্ভূত সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। সমাজবিজ্ঞান এখন এমন একটি নতুন যুগের দোরগোড়ায়, যেখানে তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রযুক্তিকে কেবল একটি যন্ত্র হিসেবে না দেখে একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে বিশ্লেষণ করার সক্ষমতার ওপর।
ঐতিহাসিকভাবে সমাজবিজ্ঞান শিল্পবিপ্লব, নগরায়ণ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক সংযোগ কীভাবে সমাজকে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করেছে। এই বিশ্লেষণগুলো আমাদের সমাজকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিন্তু আজকের পৃথিবী সম্পূর্ণ ভিন্ন। এআই এখন হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন এবং শ্রমবাজারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই প্রযুক্তিগুলো কেবল তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে না, বরং তারা সামাজিক নীতি, মানদণ্ড এবং এমনকি বৈষম্যকেও কোডিংয়ের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করছে। যখন একটি এআই অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে কাকে ঋণ দেয়া হবে বা কোন ছাত্রকে কোন কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত করা হবে, তখন এটি কেবল একটি যান্ত্রিক সিদ্ধান্ত থাকে না, বরং এটি একটি গভীর সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্ন তৈরি করে। সমাজবিজ্ঞানীদের দায়িত্ব এখন আরও গভীরতর। তাদের কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই চলবে না, বরং প্রযুক্তির নকশা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কী ধরনের সামাজিক পূর্বানুমান কাজ করছে, তা উন্মোচন করতে হবে। অর্থাৎ, তাদের গবেষণার পরিধি এখন প্রযুক্তি-উৎপাদনের ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর মধ্যেও প্রবেশ করেছে।
প্রযুক্তির এই দ্রুত বিস্তার নতুন নতুন সামাজিক বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বা স্মার্ট হোম টেকনোলজি আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। ফেসিয়াল রিকগনিশন বা বায়োমেট্রিক ডেটার ব্যবহার আমাদের গোপনীয়তার ধারণা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তৈরি করছে। সমাজবিজ্ঞানীদের এখন এ ধরনের নতুন সামাজিক বাস্তবতার উদ্ভব, এর প্রভাব এবং এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করতে হচ্ছে। এছাড়া এআই পরিচালিত প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে কীভাবে জনমত তৈরি হচ্ছে বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করাও তাদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পরিবর্তনগুলো সমাজবিজ্ঞানকে তার ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন, আন্তঃবিষয়ক এবং প্রযুক্তি-সচেতন গবেষণার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ক্লাসিক সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা যেমন এমিল দুর্খেইমের সামাজিক সংহতি, ম্যাক্স ওয়েবারের যৌক্তিকীকরণ বা কার্ল মার্ক্সের শ্রেণিসংগ্রামের বিশ্লেষণ এআই-এর যুগে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। দুর্খেইমের সামাজিক সংহতি এখন নতুন করে ভাবাচ্ছে, যখন অনলাইন সম্প্রদায়, ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষের সামাজিক বন্ধন তৈরি করছে। এ ধরনের ডিজিটাল সংহতি কী বাস্তব সমাজের সংহতির মতোই শক্তিশালী? এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো কী—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা এখনকার সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য জরুরি।
ম্যাক্স ওয়েবারের ‘লৌহ খাঁচা’ (Iron Cage) ধারণাটি এখন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে অ্যালগরিদমের দৌলতে, যেখানে মানবিক বিবেচনার জায়গায় জায়গা নিচ্ছে যান্ত্রিক নিয়মাবলি। ওয়েবার যেমন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কঠোর নিয়মকানুনের কথা বলেছিলেন, তেমনি এখন অ্যালগরিদমিক শাসন বা ‘algorithmic governance’ আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে। ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে অপরাধের পূর্বাভাস—সবকিছুই অ্যালগরিদমের যৌক্তিক হিসাবের ওপর নির্ভরশীল। এই যান্ত্রিক নিয়মাবলি কি সমাজের ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও নমনীয়তাকে ধ্বংস করছে? মার্ক্সের পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ নতুনভাবে ফিরে আসছে, যখন গুগল, ফেসবুক, বা অ্যামাজনের মতো করপোরেশন মানুষের ডেটাকে মুদ্রার মতো ব্যবহার করে বিশাল মুনাফা অর্জন করছে। এই ‘ডেটা পুঁজিবাদ’ বা ‘surveillance capitalism’ এক নতুন ধরনের শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করছে, যেখানে ডেটা সম্পদশালী এবং ডেটা-বঞ্চিত—এই দুটি শ্রেণি ক্রমেই বিভাজিত হচ্ছে।
মিশেল ফুকো’র নজরদারি ও বায়োপলিটিক্স বা জুডিথ বাটলারের পারফর্মেটিভ আইডেন্টিটির তত্ত্ব এআইর মাধ্যমে বাস্তবে নতুনভাবে ফুটে উঠছে। ফুকোর ‘প্যানপটিকন’ বা সর্বব্যাপী নজরদারির ধারণা এখন স্মার্টফোন, সিসিটিভি ক্যামেরা, এবং অনলাইন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নিয়েছে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকই প্রতিনিয়ত নজরদারির অধীন। বাটলারের তত্ত্বের আলোকে, কীভাবে অ্যালগরিদম আমাদের অনলাইন পরিচয়ে পক্ষপাত তৈরি করে বা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আজকের সমাজবিজ্ঞানীদের ‘ডেটা উপনিবেশবাদ’ বা ‘পর্যবেক্ষণমূলক পুঁজিবাদ’-এর মতো ধারণার দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে, যা প্রযুক্তি-নির্ভর ক্ষমতার নতুন কাঠামো ব্যাখ্যা করে। এসব নতুন ধারণা ও তত্ত্বের জন্ম দিয়ে সমাজবিজ্ঞান নিজেকে সময়োপযোগী করে তুলছে।
এআই-এর যুগে সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার পদ্ধতিও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ঐতিহ্যবাহী জরিপ, সাক্ষাৎকার বা ক্ষেত্রসমীক্ষার পাশাপাশি এখন সোশ্যাল মিডিয়া ডেটা, সেন্সর ডেটা, অনলাইন ট্র্যাকিং অথবা বৃহৎ ডেটা বিশ্লেষণকে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই নতুন পদ্ধতিগুলো একদিকে যেমন বিশাল তথ্যভাণ্ডার সরবরাহ করছে এবং সমাজকে বোঝার নতুন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি অন্যদিকে তথ্যের স্বচ্ছতা, পক্ষপাত এবং নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করছে। উদাহরণস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়া ডেটা বিশ্লেষণ করে সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের আচরণ বোঝা গেলেও এটি সমগ্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে কিনা, তা একটি বড় প্রশ্ন।
এছাড়া অ্যালগরিদমের পক্ষপাত (algorithmic bias) এবং এর ফলে গবেষণার ফলাফলে সৃষ্ট ত্রুটি নিয়েও সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবতে হচ্ছে। একটি অ্যালগরিদম যদি ঐতিহাসিক বৈষম্যপূর্ণ ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত হয়, তাহলে তার ফলাফলও বৈষম্যপূর্ণ হতে পারে। এ ধরনের ত্রুটি শনাক্ত করা এবং এর সমাধান খোঁজা এখন সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য একটি অপরিহার্য দক্ষতা। এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা দিচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ডেটা ব্যবহারের নৈতিক দিক, গোপনীয়তা এবং সম্মতি নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এখন এমন এক দক্ষতায় অভ্যস্ত হতে চাইছেন, যেখানে প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও সামাজিক তত্ত্বের সমন্বয় থাকে। এর ফলে ডিজিটাল সমাজবিজ্ঞান এখন একটি নতুন ধারায় পরিণত হয়েছে, যেখানে সমাজবিজ্ঞানী শুধু পর্যবেক্ষক নয়, বরং ডেটা ও প্রযুক্তির সমালোচনামূলক বিশ্লেষকও।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শ্রমবাজারের চরিত্রকে আমূল বদলে দিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, অ্যাপভিত্তিক গিগ ইকোনমি অথবা অনলাইন রিমোট মনিটরিং প্রযুক্তি শ্রমিকদের জীবনে অনিশ্চয়তা ও শোষণের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উবার ও পাঠাওয়ের মতো প্ল্যাটফর্মভিত্তিক কোম্পানিগুলো একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলেও অন্যদিকে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, মজুরি ও কাজের শর্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করছে। আবার একই সাথে ডেটা বিজ্ঞান, এআই প্রকৌশল বা প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় উচ্চশিক্ষিত একটি গোষ্ঠীর উত্থানও ঘটছে, ফলে সমাজে এক ধরনের ‘ডিজিটাল শ্রেণিবিভাগ’ তৈরি হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি, লিঙ্গ ও জাতিসত্তার ওপর প্রভাব ফেলছে, তা বিশ্লেষণ করা সমাজবিজ্ঞানীদের একটি প্রধান কাজ।
উদাহরণস্বরূপ, এআই যেসব কাজ অটোমেট করছে, তা প্রধানত নিম্ন আয়ের মানুষদের শ্রমঘন কাজ, যেমন কাস্টমার সার্ভিস, ডেটা এন্ট্রি বা উৎপাদন খাতের কিছু কাজ। এর ফলে এই শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এই প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছে ধনী ও প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজের অংশ, যারা ডেটা বিশ্লেষক, প্রোগ্রামার বা এআই ম্যানেজার হিসেবে উচ্চ বেতনের চাকরি পাচ্ছেন। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও নতুন বিভাজন তৈরি করছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই নতুন বৈষম্যকে চিহ্নিত করে, তার কারণ এবং প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন, যাতে নীতিনির্ধারকরা এর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন।
ডেটানির্ভর সমাজে ব্যক্তিপরিচয়, ভাবনা, এমনকি আত্মপরিচয়ও অ্যালগরিদম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে কনটেন্ট সাজায়, বিজ্ঞাপন দেখায় বা কী পড়বে তা নির্ধারণ করে, তা এক ধরনের ‘অ্যালগরিদমিক আত্মতা’ গঠন করছে। এই অ্যালগরিদমগুলো আমাদের পছন্দ, বিশ্বাস ও বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রভাবিত করে, যা আমাদের সত্যিকারের আত্মপরিচয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীদের এখন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে—এই প্রযুক্তিগুলি কীভাবে পরিচয় নির্মাণে পক্ষপাত তৈরি করে? কীভাবে জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম বা শ্রেণিকে বৈষম্যমূলকভাবে উপস্থাপন করে?
উদাহরণস্বরূপ, একটি অ্যালগরিদম যদি কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের মানুষকে বারবার নেতিবাচক কনটেন্ট দেখায়, তাহলে তা তাদের সম্পর্কে সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। একইভাবে অ্যালগরিদমগুলো যদি নারীদের জন্য শুধু নির্দিষ্ট ধরনের বিজ্ঞাপন বা কনটেন্ট সাজায়, তাহলে তা তাদের ভূমিকা সম্পর্কে চিরাচরিত ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই ধরনের ‘filter bubble’ বা ‘echo chamber’-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন, যা মানুষের চিন্তাভাবনাকে সংকুচিত করে এবং সমাজের বৈচিত্র্যকে ক্ষুণ্ন করে। এই ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ হলো অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত, মানবিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিচয় গঠনের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করা।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও এআইয়ের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য, ডিপফেইক ভিডিও, স্বয়ংক্রিয় বটের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার প্রবণতা সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য চিন্তার বিষয়। এআই ব্যবহার করে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন বা বার্তা পাঠিয়ে ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা হচ্ছে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। এআইনির্ভর প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যেমন—পুলিশিং, কল্যাণমূলক সহায়তা বা ভিসা অনুমোদনে অ্যালগরিদমের ব্যবহার নিয়মতান্ত্রিক স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলে। একটি অ্যালগরিদম কেন একটি সিদ্ধান্ত নিল, তা যদি বোঝা না যায়, তাহলে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন। সমাজবিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন নীতিনির্ধারকদের সচেতন করে এবং ন্যায়বিচারমূলক ও স্বচ্ছ প্রযুক্তির দাবি তুলে।
এই প্রযুক্তি কীভাবে ক্ষমতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে, তা বিশ্লেষণ করাও জরুরি। ক্ষমতা এখন কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, এটি প্রযুক্তিগতও। যারা ডেটা ও অ্যালগরিদমের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, তারাই সমাজে নতুন ক্ষমতার অধিকারী। সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ হলো এই নতুন ক্ষমতা কাঠামোকে চিহ্নিত করা এবং এর ফলে সমাজের ওপর কী প্রভাব পড়ছে তা বিশ্লেষণ করা। এটি তাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, নাগরিক অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সমাজবিজ্ঞানের কাজ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এখানে ডিজিটাল বৈষম্য, প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। উন্নত বিশ্বে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কৃষি, স্বাস্থ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকলেও স্থানীয় চাহিদা ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা উপেক্ষিত হলে তা বৈষম্য আরও বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি গ্রামীণ কৃষকদের জন্য এআই-নির্ভর প্রযুক্তি আনা হয়, কিন্তু তাদের সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা আর্থিক সক্ষমতা না থাকে, তাহলে এটি কেবল তাদের পিছিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত গ্রামীণ সমাজে প্রযুক্তি কীভাবে পৌঁছাচ্ছে, তা কোন গোষ্ঠীর জন্য সহায়ক, আবার কাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়—এ বিষয়ে সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা। শহর ও গ্রামের ডিজিটাল ব্যবধান, তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং রাজনৈতিক প্রযুক্তির ব্যবহার—এসবই আগামী দিনের সমাজবিজ্ঞানের মূল ক্ষেত্র হবে। সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত স্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে প্রযুক্তির প্রয়োগের একটি ন্যায়সংগত মডেল তৈরি করতে নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করা।
এআই-এর যুগে সমাজবিজ্ঞান একটি আত্ম-সমালোচনামূলক (reflexive) ও নীতিনিষ্ঠ (ethical) জ্ঞানের চর্চায় রূপ নিতে যাচ্ছে। নিজস্ব গবেষণা পদ্ধতির পাশাপাশি প্রযুক্তি নকশাকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ন্যায়বিচার ও মানবিক প্রযুক্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের নিতে হবে। এআই-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ, শিক্ষা কারিকুলাম এবং সমাজ-প্রযুক্তি সম্পর্ক বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞানীকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বজুড়ে ‘ক্রিটিক্যাল এআই স্টাডিজ’ বা ‘সমালোচনামূলক এআই অধ্যয়ন’ একটি নতুন শাখা হিসেবে গড়ে উঠছে, যেখানে সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধ্যয়ন একত্র হচ্ছে। এই সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান আরও কার্যকরভাবে এআই-এর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে।
এআই কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োজন এখন আরও বেশি। প্রযুক্তি আমাদের সমাজকে কীভাবে পরিবর্তন করছে, তার গভীর বিশ্লেষণ, সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে পূর্বাভাস এবং এর থেকে উদ্ভূত নৈতিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সমাজবিজ্ঞানের বিকল্প নেই। সমাজবিজ্ঞানকে তার কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণী শক্তি এবং মানবিক বোধকে সঙ্গে নিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি সমাজবিজ্ঞান নিজেকে সময়োপযোগী করে তোলে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তার সংলাপে যুক্ত হয়, তাহলে এটি এআই যুগে একটি পথপ্রদর্শক শক্তি হিসেবে উঠে আসবে। সমাজকে আরও ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক করার লড়াইয়ে সমাজবিজ্ঞান হবে অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী