নিজস্ব প্রতিবেদক : নতুন অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের ৩৯ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যা আগের অর্থবছরের কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার নতুন অর্থবছরের কৃষিঋণ বিতরণের নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। নীতিমালায় গবাদি পশুর পাশাপাশি ছাগল পালনের জন্যও পৃথক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নীতিমালার আওতায় ছাগল পালনের জন্য একজন কৃষক বা খামারি সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। এ ঋণের সুদহার হবে মাত্র ৪ শতাংশ। এতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৫০টি ছাগল পালনের জন্য অনধিক ১০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া যাবে। খামার তৈরিতে ঘর নির্মাণ বাবদ এককালীন প্রদত্ত ঋণও কৃষিঋণ হিসেবে গণ্য হবে। তবে ৫০টির বেশি ছাগল পালনের বৃহৎ বা বাণিজ্যিক খামারের অবকাঠামো নির্মাণে নেয়া ঋণ কৃষিঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
সংস্থাটি বলছে, কৃষি খাত যান্ত্রিকীকরণের ফলে এ খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ঋণের চাহিদা। যদিও চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত কৃষিঋণ পান না তারা।
গত এক মাসের ব্যবধানে কৃষিঋণ বিতরণ সামান্য বাড়লেও অর্থবছরের হিসেবে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।
দেশের বড় অংশের জীবন-জীবিকার মাধ্যম কৃষি। মূলত বীজ, সার, কীটনাশক কেনা, সেচব্যবস্থা স্থাপন এবং অন্যান্য কৃষিবিষয়ক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ঋণ নেন কৃষক ও উদ্যোক্তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ায় বাড়ছে ঋণের চাহিদা। যদিও কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।
এসব কারণে কৃষিঋণ বিতরণ ও তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের কর্মসংস্থান এখনও ৪০ শতাংশের মতো। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা। কারণ আমরা এখনও গ্রাম থেকে জনগোষ্ঠীকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বা সার্ভিস ওরিয়েন্টেড সেক্টর ইত্যাদিতে নিতে পারিনি।’
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা ও বৃষ্টির কারণে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঋণ পরিশোধ অব্যাহত রেখেছেন। এতে ঋণ বিতরণ কমলেও বেড়েছে আদায়। গভর্নর বলেন, ‘প্রকৃত কৃষক বা উদ্যোক্তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয় না। এক্ষেত্রে কৃষিঋণ বিতরণ ও তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জোর দিচ্ছে।’
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এগ্রিকালচার প্রাইজ স্ট্যাবিলিটি খুব দরকার। ৪০ শতাংশ যেটা আমরা বলছি তার একটা বড় অংশ নন-ফার্ম অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে জড়িত।’
বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড ল্যান্ডিং প্রসেসের সঙ্গে মেলানো যাবে না। একটা ক্রপ যদি আমার মিনিমাম চার মাস লাগে ১২০ দিনের নিচে কোনো ধান আসবে না। ক্রপ সাইকেল যদি চার মাস হয় তাহলে বিক্রি করার জন্য আরও দুই মাস সময় দিতে হবে। তাহলে ছয় মাসে একটা ক্রপ সাইকেল আমি করতে পারি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের মধ্যে ন্যূনতম ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করতে হয়। কোনো ব্যাংক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, দেশের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এ নিয়ে কাজ করার সক্ষমতা নেই।
সার্বিক কৃষি ও পল্লী ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং নীতি প্রণয়নে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তুতকৃত ওয়েববেইজড এগ্রি ক্রেডিট এমআইএস সফটওয়্যার চালুর উদ্বোধনও করেন গভর্নর।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি ঘোষণা অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নরবৃন্দ, বিএফআইইউ প্রধান, অ্যাডভাইজার টু গভর্নর, চিফ ইকোনমিস্ট, নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকবৃন্দ, কৃষিঋণ বিভাগের কর্মকর্তা এবং তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ১৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ২৫ হাজার ১২০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিবছর কৃষি সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এ ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছেÑনিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভুসি ও পল্লী ঋণ খাতে যে কোনো পরিমাণের ঋণ/বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্ট গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা সংযোজন এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের আওতাভুক্ত শস্য-ফসল খাতসহ অন্যান্য সকল খাতে সর্বোচ্চ ২.৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নতুন ঋণ আবেদন বা বিদ্যমান ঋণ নবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিআইবি রিপোর্টের ক্ষেত্রে আরোপযোগ্য সার্ভিস চার্জ মওকুফ করা।
প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দের হার ২০ শতাংশে উন্নীতকরণ এবং নতুনভাবে সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে বরাদ্দের হার ২ শতাংশে নির্ধারণ করা; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে ডিপি নোট (১০ টাকা থেকে ৫০ টাকার স্ট্যাম্প/সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক), স্ট্যাম্পবিহীন সেটার অব হাইপোথিকেশন ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টি ব্যতীত অন্য কোনো চার্জ ডকুমেন্ট গ্রহণ না করার নির্দেশনা প্রদান।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিতে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালায় উল্লিখিত ফসল ঋণ, মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন এবং প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট উপখাতসমূহে ঋণ প্রদান করা যাবে মর্মে প্রদত্ত নির্দেশনার মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতা বৃদ্ধির প্রতিও গুরুত্বারূপ করা হয়েছে।
কতিপয় নতুন শসা ও ফসল যেমন। খিরা, কচুর লতি, কাঁঠাল, বিটরুট, কালোজিরা, বস্তায় আদা, রসুন ও হলুদ চাষ, খেজুর গুড় উৎপাদন প্রকৃতির ঋণ নিয়মাচার অন্তর্ভুক্তি।
অঞ্চলভেদে বাস্তবতার নিরিখে কৃষকদের প্রকৃত চাহিদার ভিত্তিতে ঋণ নিয়মাচারে ফসলভিত্তিক নির্ধারিত ঋণ/বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি/হ্রাস করার সুযোগ প্রদান।
ব্যাংক কর্তৃক কৃষিঋণ বিতরণ ও আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করার এবং নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী কৃষকদের পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা প্রদানকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Discussion about this post