Print Date & Time : 26 August 2025 Tuesday 10:24 am

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ লঙ্ঘন করেও ২৫ বছর চেয়ারম্যান

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচবিএম ইকবাল ছিলেন ঢাকার ত্রাস। শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ব্যাংকের অনুমোদন নেন। চেয়ারম্যান হয়ে ব্যাংকের কাছে নিজের ভবন ভাড়া দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। টানা ২৫ বছর ব্যাংকটির নেতৃত্বে থেকে কর্মীদের মারধরসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক নির্দেশনাকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এ নিয়ে দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকায় ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব ছাপা হলো আজ

শেখ শাফায়াত হোসেন : একদিকে সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে বড় একটি ব্যাংকের মালিক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার একাধিক মেয়াদে মসনদ পরিচালনা করছে। এ সময় ব্যবসাও বড় হচ্ছে ডা. এইচবিএম ইকবালের। রাজপথে মিছিলে গোলাগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তার সেই অগ্নিমূর্তি দেখা যায় ব্যাংক খাতেও। অর্থশালীদের নিয়ে চলতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি উন্নাসিক ভাব। এসব কারণে কেন্দ ীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি পরিণত হয় একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে।

এই ব্যাংকটির নাম দি প্রিমিয়ার ব্যাংক। ৫ আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে সবশেষ এই ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে কেন্দ ীয় ব্যাংক জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে ঘাটতি, ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থতা এবং সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ৪৭’ ধারার বিধানের আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ওই আইনের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পর্ষদের কার্যকলাপ ব্যাংক বা এর আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি বা ক্ষতিকর হতে দেখলে জনস্বার্থে পর্ষদ ভেঙে দেয়া বা পুনর্গঠন করার ক্ষমতা রাখে।

এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেÑএমনটা আশা করেন ব্যাংকটির সঙ্গে জড়িতরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে ব্যাংকটির কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে; যা ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের অত্যধিক ক্ষমতার প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়।

দি প্রিমিয়ার ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (পিবিএসএল) ঋণ বিতরণ, সুদ আরোপ ও মওকুফের ক্ষেত্রে কিছু অনিয়মের উল্লেখ রয়েছে। ঋণের তথ্য গোপন করারও অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিবিএসএলকে ২৩০ কোটি টাকা ঋণ দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংকটির বনানী শাখা কর্তৃক প্রদত্ত ১২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার তথ্য বনানী শাখার শ্রেণিকৃত ঋণের (সিএল) বিবরণীতে প্রদর্শন করা হলেও অবশিষ্ট ১০৬ কোটি টাকার তথ্য সিএল বিবরণী হতে কৌশলে গোপন রাখা হয়; যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ওই পরিদর্শন পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আরও দেখা যায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৮/১)(খ) ধারা লঙ্ঘন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পিবিসিএলকে দেয়া ঋণের ওপর মাত্র ৫ শতাংশ সুদ আরোপ করা হয়, অথচ তখন ব্যাংকটির ঋণের ঘোষিত সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ।

২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণী অনুসারে পিবিএসএলের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ওই শাখার পারফরম্যান্স রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এক বছরের নিট কমিশন আয় মাত্র ৭২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধ কার্যক্রমের (সিএসআর) টাকাও বেহাত হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকে। জানা গেছে, প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সংঘস্মারক অনুযায়ী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের মোট পরিচালন মুনাফার ১ শতাংশ অথবা ১ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি তা ফাউন্ডেশনে অনুদান হিসেবে প্রদানের বিধান রয়েছে। তবে সেই বিধান লঙ্ঘন করে এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কোনো অনুমোদন ছাড়াই ২০২৩ সালে ৩০ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালে আরও ৫ কোটি টাকা অনুদান নেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশন। সেই অনুদান নিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ন্ত্রণাধীন বা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ব্যয় দেখানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জেড রহমান প্রিমিয়ার ব্যাংক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

তাছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংক কর্তৃক আর্থিক বিবরণীতে ব্যাংক ও রিলেটেড পার্টির মধ্যে সম্পর্ক ও সংঘটিত লেনদেনের তথ্য উল্লেখ করার অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন কিংবা আংশিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলধন ও সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছেও বলে জানতে পারেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রিমিয়ার ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ২০২৩ সালে ‘কম্পেনসেশন রিয়ালাইজড’ হিসাব থেকে ২৫ কোটি টাকা আয় খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে; যা ইসলামি শরিয়াহ আইনের চরম লঙ্ঘন বলেও জানায় কেন্দ ীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল বলে মনে করেন এর গ্রাহক ও কর্মীদের অনেকে।

গত ১৯ আগস্ট নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ ীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মের বিষয়ে নতুন পর্ষদ ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যাংকটির আমানতকারীরা।