রোদেলা রহমান : ঢাকার আকাশরেখা যখন সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে, মতিঝিলের কাচের টাওয়ারগুলো তখন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে থাকে। লিফটে ওঠে গেলে দেখা যায় ঝলমলে ফ্লোর, যেখানে সোনালি অক্ষরে লেখা নাম—কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্ট।
কক্ষটি সাজানো-গোছানো, দেয়ালে বিশাল স্ক্রিন, করিডরে সুগন্ধি কার্পেট, আর ডেস্কে সর্বাধুনিক ম্যাকবুক। এখানে কর্মরত তরুণীরা টেইলারড স্যুট পরে হেডসেট কানে লাগিয়ে টিপে চলেছেন বোতাম। সবকিছু নিখুঁত। যেন এই বিভাগের চেয়ে আধুনিক আর কিছু নেই।
কিন্তু কক্ষের ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা। কারণ তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। নেই প্রয়োজনীয় বাজেট, কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা। কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোনো ইস্যুতে সরাসরি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি বিজ্ঞপ্তি আটকে থাকে চেয়ারের পেছনে বসা এক অদৃশ্য শৃঙ্খলের হাতে-চেয়ারম্যান আর এমডির অনুমোদন ছাড়া এখানে কোনো শব্দ বের হয় না। আধুনিক সাজসজ্জার আড়ালে এই বিভাগ যেন বন্দি। অথচ উন্নত বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে এ বিভাগকে সামনে নিয়ে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধস। ওয়াল স্ট্রিট কেঁপে উঠেছে। সিটি ব্যাংকের ব্যালান্সশিট হুমকির মুখে, বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের দাম নামিয়ে দিচ্ছে প্রতি ঘণ্টায়। মিডিয়ার ক্যামেরা প্রতিদিনই সদর দপ্তরের সামনে ভিড় করছে।
কিন্তু ভেতরে ভিন্ন দৃশ্য। সিটি ব্যাংকের কমিউনিকেশন টিম সরাসরি সিইওর টেবিলে বসে। তারা শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি লেখেনি, বরং নীতি নির্ধারণ করেছে কীভাবে ব্যাংক গ্রাহকের আস্থা ফেরাবে। তারা মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র পাঠিয়েছে, খোলাখুলি বলেছে ‘হ্যাঁ, আমাদের সমস্যা আছে। কিন্তু আপনার টাকাটা নিরাপদ।’
তাদের কণ্ঠে ছিল কর্তৃত্ব, তাদের বার্তায় ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা। সিটি ব্যাংক টিকে গেছে, আস্থার ফাঁক বন্ধ করেছে পিআর বিভাগের শক্তি দিয়েই।
ঢাকায় কি এমনটা সম্ভব? এখানে পিআর বিভাগের আধুনিক কক্ষ আছে, কিন্তু সংকটে তারা কেবলই অপেক্ষা করে ‘চেয়ারম্যান কী বলবেন?’ অথচ সংকটে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই তো প্রকৃত শক্তি।
লন্ডনের ঠান্ডা সকালে একসময় বার্কলেস ব্যাংকের নাম কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। সংবাদমাধ্যম তখন শিরোনাম করেছিল ‘ইধৎপষধুং রহ ঝপধহফধষ’। শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষিপ্ত, গ্রাহকরা আতঙ্কিত।
কিন্তু তাদের কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট দাঁড়িয়ে গেল সম্মুখভাগে। তারা লুকালো না, তারা এড়ালো না। সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে বলল ‘আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা তা সংশোধন করব।’
এই স্বচ্ছতা এক নতুন গল্প তৈরি করল। মিডিয়া ধীরে ধীরে আবার আস্থা রাখতে শুরু করল, গ্রাহকরা বুঝল ব্যাংক অন্তত সত্য বলছে।
বাংলাদেশে কিন্তু উল্টো। এখানে পিআর টিমকে বলা হয়- ‘এটা ঢেকে দাও, একটা বিজ্ঞাপন দাও, পত্রিকা ম্যানেজ করো।’ অথচ সত্যকে এড়ানো মানেই আস্থার মৃত্যু। সাজানো অফিসে বসে থাকা অফিসার জানে, তার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই – সে শুধু সইয়ের জন্য অপেক্ষমাণ এক নীরব চরিত্র।
ডিবিএস ব্যাংক একসময় ছিল সিঙ্গাপুরের মাঝারি মানের ব্যাংক। কিন্তু তারা দ্রুত বুঝেছিল- ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কেবল হিসাবের খাতায় নয়, বরং মানুষের আবেগে।
তাদের কমিউনিকেশন বিভাগকে দেয়া হলো সর্বোচ্চ মর্যাদা। ব্যাংকের ব্র্যান্ড গড়তে এই টিম পরিকল্পনা করেছে গল্পভিত্তিক বিজ্ঞাপন, ডিজিটাল রেসপন্স সিস্টেম এবং সংকট মোকাবিলার আলাদা প্রটোকল। প্রতিটি গ্রাহক অভিযোগের জবাব আসে ঘণ্টার ভেতর, প্রতিটি মিডিয়া প্রশ্নের উত্তর আসে স্বচ্ছভাবে।
আজ ডিবিএস এশিয়ার সেরা। তাদের কমিউনিকেশন টিমকে বলা হয় ওহারংরনষব ঋড়ৎপব- দৃশ্যমান না হলেও তারা প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড।
ঢাকার ব্যাংকগুলোতেও আধুনিক সরঞ্জাম আছে-স্টুডিও লাইট, ডিজিটাল ডেস্ক, হাই-স্পিড সার্ভার। কিন্তু শক্তিহীন এই দলগুলোর গল্প যেন সাজানো পুতুল নাটক- ঝকঝকে মঞ্চ, অথচ নায়ক নেই।
টোকিওর সনি-আক্রমণের মাঝেও আস্থা
সনি যখন সাইবার আক্রমণে বিপর্যস্ত হলো, কোটি কোটি গ্রাহকের তথ্য চুরি হয়ে গেল। বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, আতঙ্ক। কিন্তু তাদের পিআর টিম এক মুহূর্ত দেরি করেনি। সরাসরি গ্রাহকদের কাছে ইমেইল পাঠিয়েছে, মিডিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন ব্রিফ করেছে। তাদের বার্তা ছিল ‘আপনার ডেটা আক্রমণের শিকার হলেও আমরা আছি আপনার পাশে।’
গ্রাহকের রাগ ছিল, কিন্তু আস্থা পুরোপুরি ভাঙেনি। কারণ পিআর বিভাগকে দেয়া হয়েছিল পূর্ণ কর্তৃত্ব যেন তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কীভাবে সংকটের ভাষা তৈরি হবে।
ঢাকায় হয়তো একই আক্রমণ ঘটলে প্রথম কাজ হতো তথ্য গোপন করা, তারপর সাংবাদিকদের ফোন করে থামানোর চেষ্টা, আর শেষে বলির পাঁঠা বানানো সেই আধুনিক সাজঘরে বসা পিআর অফিসারকে।
চলুন ফিরে আসি ঢাকায়। এক ব্যাংকের সদর দপ্তরের ১২ তলায় পিআর বিভাগের গ্লাসরুম। দেয়ালে বিশাল স্লোগান লেখা ‘ডব ইবষরবাব রহ ঞৎধহংঢ়ধৎবহপু.’
কিন্তু ভেতরে যারা বসে আছেন, তারা জানেন তাদের কোনো কণ্ঠ নেই। তারা শুধু ‘প্রেস রিলিজ’ লিখে সইয়ের অপেক্ষা করেন। মিডিয়া ফোন করলে তারা বলতে পারেন না কিছুই, শুধু বলেন ‘আমরা অনুমতি ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’
প্রতিটি শব্দ আটকে থাকে অনুমোদনের ফাইলে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত গিলে খায় চেয়ার। এটা যেন সিনেমার এক দৃশ্য যেখানে বন্দি মানুষদের হাতে চকচকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে, কিন্তু তার গোলা-বারুদ নেই। সাজানো কক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তি, কিন্তু সবকিছুই কেবল প্রদর্শনী।
অ্যাপলের প্রতিটি লঞ্চ ইভেন্ট বিশ্বকে মুগ্ধ করে। কিন্তু পেছনে থাকে তাদের কমিউনিকেশন টিম। তারা জানে কীভাবে একটি ফোনকে শুধু যন্ত্র নয়, বরং জীবনধারার প্রতীক বানাতে হয়।
অ্যাপলের পিআর টিমের হাতে থাকে পূর্ণ ক্ষমতা- তারা ঠিক করে বার্তা, তারা তৈরি করে গল্প। এজন্য মানুষ আইফোন কিনে আবেগ দিয়ে, শুধু প্রযুক্তি দিয়ে নয়।
ঢাকার ব্যাংকগুলোও যদি তাদের গ্রাহককে বলত- ‘আমরা আপনার ভবিষ্যতের সঙ্গী, আমরা আপনার বিশ্বাস’ তাহলে হয়তো আজ তারা শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হতো।
কিন্তু এখানে ব্র্যান্ডিং মানে চেয়ারম্যানের ছবি সংবাদপত্রে ছাপানো, এমডির জন্মদিনে বিজ্ঞাপন ছাপানো। গল্প তৈরি হয় না, কেবল সাজসজ্জার প্রদর্শনী।
ঢাকার কোনো এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান একদিন ঘোষণা দিলেন আজ থেকে আমাদের কমিউনিকেশন টিম শুধু সাজানো অফিসে বসবে না, তারা হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশ। সংকটে প্রথমে তারা বলবে কী করতে হবে, গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবে, আর মিডিয়ার সামনে সত্য বলবে।’
এই ঘোষণার পরই বদলে যায় দৃশ্য। আধুনিক সাজসজ্জা আর নিষ্ক্রিয়তার আড়ালে যেসব মেধা বন্দি ছিল, তারা একে একে বেরিয়ে আসে আলোয়। তারা তৈরি করে নতুন গল্প, নতুন আস্থা। গ্রাহকরা আবার ব্যাংকের দিকে আঙুল না তুলে হাত বাড়ায় বিশ্বাসে। এভাবেই হয়তো বাংলাদেশের ব্যাংক একদিন বিশ্বকে বলতে পারবে- ‘আমাদের ব্র্যান্ড শুধু কাঁচে নয়, আস্থায় গড়া।’
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে কমিউনিকেশন ও পিআর বিভাগ সাজানো-গোছানো, প্রযুক্তি-সজ্জিত, কিন্তু ক্ষমতাহীন। অথচ নিউইয়র্কের সিটি ব্যাংক, লন্ডনের বার্কলেস, সিঙ্গাপুরের ডিবিএস, টোকিওর সনি কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাপল প্রমাণ করেছে- এই বিভাগই সংকট সামলায়, আস্থা তৈরি করে, ব্র্যান্ড গড়ে।
এখানে মূল পার্থক্য হলো কর্তৃত্ব। বিশ্বে পিআর টিম সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলাদেশে তারা সইয়ের জন্য অপেক্ষা করে।
একদিন হয়তো এই অদৃশ্য শৃঙ্খল ভাঙবে। সাজানো অফিস শুধু প্রদর্শনী থাকবে না, হবে শক্তির ঘাঁটি। তখনই বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের গর্বে বলতে পারবে- ‘আমাদের শক্তি হলো আমাদের কমিউনিকেশন।’

Discussion about this post