জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীন, সৌদি আরব ও মরক্কো থেকে মোট ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সার এবং চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই সার আমদানি করতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে আমদানির এই অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তির আওতায় চীনের ব্যানিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং লিমিটেড থেকে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানি করা হবে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৯ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭৮ কোটি টাকার বেশি। প্রতি টন ডিএপি সারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৭২ দশমিক ৫০ ডলার।
এছাড়া মরক্কোর ওসিপি নিউট্রিক্রপস থেকে ৩০ হাজার টন টিএসপি সার আনার অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা কমিটি। এর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ২১৫ কোটি টাকা। প্রতি টনের মূল্য ৫৮৫ দশমিক ৩৩ ডলার। একই প্রতিষ্ঠান থেকে আরও ৪০ হাজার টন টিএসপি সার আমদানির আরেকটি প্রস্তাবও অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
মরক্কোর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আবার ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানির আরেকটি চুক্তি হয়েছে। এর জন্য ব্যয় হবে ৩ কোটি ৪ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৭৩ কোটি টাকা। প্রতি টনের দাম ধরা হয়েছে ৭৬০ দশমিক ৩৩ ডলার।
সবশেষে সৌদি আরব থেকেও নির্দিষ্ট পরিমাণ সার আমদানির পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। এভাবে তিন দেশ থেকে সর্বমোট ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সার আমদানিতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার বেশি।
বৈঠকে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে আতপ চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ।
এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, চাল আমদানি শুরু হলে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বর্তমানে দেশে চালের মজুত থাকলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
সম্প্রতি চালের দাম কিছুটা কমলেও সবজির দাম ঋতুভেদে ওঠানামা করছে। ড. সালেহউদ্দিন স্বীকার করেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার এখনও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। পাইকার ও মজুতদাররা বাজারে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
প্রতিবেশী দেশ হঠাৎ করে নন বাসমতী চাল রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রভাব পড়বে না।
বৈঠক শেষে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ অর্থের একটি অংশ দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে।
তবে তিনি স্বীকার করেন, এই প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। পাচারকারীরা বিভিন্ন কৌশলে অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে ও বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বিষয়টি এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে এবং তাদের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট-সংক্রান্ত তথ্য সরকারের হাতে রয়েছে। প্রায় ১১-১২টি মামলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ২০০ কোটি টাকার বেশি জড়িত।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে তিনটি পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশেষ করে শিশু ও মায়েদের মধ্যে পুষ্টির ঘাটতি প্রকট। এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাদের চালের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং ডিমের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তিনি মনে করেন, খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনা এবং প্রোটিনের উৎস বাড়ানো ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
উপদেষ্টা বলেন, চীন, সৌদি আরব ও মরক্কো থেকে সার আমদানির সাম্প্রতিক অনুমোদন সারের সংকট মোকাবিলা করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। পাশাপাশি চাল আমদানির সিদ্ধান্ত বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া সফল হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে অদক্ষতা ও পুষ্টিহীনতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

Discussion about this post