শেখ শাফায়াত হোসেন : তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) এক্সেসরিজ বা আনুষঙ্গিক পণ্যের আড়ালে প্রিন্টেড পিভিসি শিট, পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার (যা প্যানাফ্লেক্স ব্যানার হিসেবে পরিচিত), তারপলিন (ত্রিপল), পিভিসি লেদার, পিউ লেদার ও পিভিসি কোটেড ফেব্রিক দেশে আনছেন একশ্রেণির অসাধু আমদানিকারকরা। এর মধ্যে প্রিন্টেড পিভিসি শিটের নামে টেবিল ক্লথ আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে, যা দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ব্যবহƒত হচ্ছে। অথচ এটা বন্ডেড সুবিধার পণ্য নয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় শিল্পমালিক ও সাধারণ আমদানিকারকরা। পাশাপাশি সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গার্মেন্ট খাতের এ ধরনের পণ্যের ব্যবহার না থাকা সত্ত্বেও আমদানিকারকরা বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার করে পণ্যগুলো দেশে এনে খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। বন্ডেড সুবিধার আওতায় মাত্র এক শতাংশ শুল্ক দিয়ে এসব পণ্য আমদানি করছেন গার্মেন্ট খাতের এক্সেসরিজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অথচ একই ধরনের পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য আমদানি করতে ৯৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের। এ কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। বিপাকে পড়ছেন ঢাকার বংশাল ও সিদ্দিকবাজারকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা।
জানা গেছে, বন্ডেন্ড ওয়্যারহাউসের প্রাপ্যতার সুবিধার আওতায় এই পণ্যগুলো আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে উচ্চ মুনাফা করছেন এক্সেসরিজ খাতের প্রতিষ্ঠান মালিকরা। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এমন অন্তত এক ডজন প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে।
প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র এক শতাংশ শুল্ক দিয়ে কিছু পণ্য আমদানি করতে পারে, যা গার্মেন্ট খাতের পণ্য রপ্তানিতে প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহƒত হয়। এই সুবিধার আওতায় একই ধরনের পণ্য যা অন্যান্য কাজেও ব্যবহার হয়। সে ধরনের কিছু পণ্য বেশি করে আমদানি করছে এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রয়েছে পিউ লেদার যা জুতা, স্কুল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার হয়। তাছাড়া প্যাকেজিংয়ের জন্য আনা পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার পরবর্তী সময়ে পল্টন, নীলক্ষেত ও মিরপুর এলাকার প্রিন্টিং ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে সরকারের দেয়া সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার এ ধরনের পণ্য আমদানিতে এক শতাংশ শুল্ক আদায় করছে, যেখানে একই ধরনের পণ্য আমদানি করতে গার্মেন্ট খাতের বাইরের আমদানিকারকদের ৯৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।
জানা গেছে, বিএন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের আমদানি বিল অব এন্ট্রির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সম্প্রতি তারা বিপুল পরিমাণ প্যাকেজিং পণ্য আমদানি করেছে। এর জন্য তাদের শুল্ক দিতে হয়েছে মাত্র এক শতাংশ।
এই পণ্যগুলো খোলা বাজারে বিক্রি হলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ৯৪ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েন।
এছাড়া ওশেন এক্সেসরিজ লিমিটেড, মেগা প্যাকেজিং বাংলাদেশ লিমিটেড, তাসিহাইয়ান লিমিটেড, ইন্ডিগো প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড, টেক্স-ট্রিম অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, জিস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো. লিমিটেড, মেসার্স এমএফ পলি ইন্ডাস্ট্রিস, এন,এম এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, অ্যাক্টিভ এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রি ও মেসার্স জে আর এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আমদানিকৃত পণ্যও খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ হিসেবে প্রিন্টেড পিভিসি শিট আমদানি হচ্ছে। এক টন পিভিসি শিট আমদানি করতে এ খাতের ব্যবসায়ীদের শুল্কসহ দাম পড়ছে ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ওপরে। যেখানে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমদানি করতে হলে এর দাম পড়বে ৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
একই পণ্য আমদানিতে শুল্কের এত বড় ব্যবধান থাকায় এক্সেসরিজ খাতের আমদানিকারকরা এই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এই বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী শেয়ার বিজকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে এই বন্ডেড ওয়ারহাউস সুবিধার অপব্যবহার এতটা দেখা যায়নি, যতটা দেখা গেছে গত এক বছরে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ খাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তদারকির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কাস্টমস কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কিছু সংখ্যক শুল্ক গোয়েন্দাকে হাত করে এই ধরনের পণ্য দেশে আনছেন এক্সেসরিজ ব্যবসায়ীরা। এর ফলে সাধারণ আমদানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন এবং সরকার প্রতি অর্থবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
ওই ব্যবসায়ী আরও বলছেন, কিছু পণ্য যা কখনোই গার্মেন্ট এক্সেসরিজ হিসেবে ব্যবহƒত হওয়ার কথা নয়, সে ধরনের পণ্যও আমদানি করছেন এক্সেসরিজ খাতের ব্যবসায়ীরা, যেমন প্রিন্টেড পিভিসি শিট, পিউ লেদার, পিভিসি কোটেড টেক্সটাইল ফেব্রিক ও পিভিসি ফ্লেক্স। শুল্ক কর্মকর্তারা কেন বন্ডেড সুবিধার আওতায় এগুলো আমদানি করতে দিচ্ছেন, তা বোধগম্য নয় বাণিজ্যক আমদানিকারকদের কাছে। ঘুস ছাড়া এ ধরনের পণ্য আমদানির কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মাত্র এক শতাংশ শুল্কে এসব পণ্য আমদানি করে যখনই খোলা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে, তখন প্রায় দ্বিগুণ দামে আমদানি করা পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়ছেন গার্মেন্ট খাতের বাইরের ব্যবসায়ীরা। তাদের গুদামে পণ্য অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকছে দিনের পর দিন।
বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার রোধে শুল্ক গোয়েন্দাদের পণ্যের এইচএস কোড ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ৩৯২০.৪৯.২৯, ৩৯২০.৪৯.২০, ৫৯০৩.২০.৯০, ৫৯০৩.১০.৯০, ৩৯২১.৯০.৯৯ এইচএস কোডের পণ্যগুলোর গার্মেন্ট এক্সেসরিজ হিসেবে খুব একটা ব্যবহার নেই। তারপরও এগুলো দেশে এনে বংশাল, সিদ্দিক বাজার ও নয়াপল্টনের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন এক্সেসরিজ খাতের ব্যবসায়ীরা।
সিএসএল ও শুল্কগোয়েন্দাসহ যতগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত তাদের মাধ্যমে কাটিং তদারকির আহ্ববান জানান খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রতিটি কন্টেইনার শতভাগ পরীক্ষা করতে হবে। এই পণ্যগুলো প্রকৃতপক্ষে পোশাক খাতের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার হয় কি না, তা নিশ্চিত হয়ে পণ্য খালাস করতে হবে।
এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করে রেক্সিন ম্যাটারিয়াল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. সেলিম শেয়ার বিজকে বলেন, রেক্সিন আমদানিকারকরা বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে। আগে আমি নিজে রেক্সিন আমদানি করতাম। প্রতি মাসে ৫০-৬০ লাখ টাকা ট্যাক্স দিতাম। এখন আর আমদানি করি না। কারণ মার্কেটে বেশি দামে এগুলো বিক্রি করতো পারব না। অথচ গার্মেন্ট এক্সেসরিজের নামে একই ধরনের পণ্য এনে খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে অসাধু গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা টাকা বানাচ্ছে। এই টাকা দেশে রাখে না, পাচার করে। কারণ এগুলো তো অবৈধ টাকা। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া টাকা। এটা তারা ব্যবসার মুনাফা হিসেবে কীভাবে দেখাবে?
এই ব্যবসায়ী বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধ করতে সরকারের আরও বেশি তৎপর হতে হবে। এতে বাজার ভারসাম্য রক্ষা হবে।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post