Print Date & Time : 26 August 2025 Tuesday 10:34 am

গুজবের ফাঁদ ও গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা

আকলিমা আক্তার সোমা :‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন—

‘এই নিয়েছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে,

চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’

গুজবের পেছনে ছোটার নেশাটা ঠিক তা-ই। মানুষের তিলকে তাল করার প্রবণতার কারণেই সেই গুজবের গায়ে লাগে নিত্যনতুন রং ও মাত্রার ছোঁয়া।

যেমনটা দেখা যায় বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে, চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির পর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বাতাসে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি ইত্যাদি গুজবের ভয়াবহতায়। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সর্বত্রই গুজব ছড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া—সর্বত্রই গুজবের ডালপালা ছড়িয়েছে। মাইকেল জ্যাকসন বেঁচে আছেন, প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন—এমন গুজব সম্প্রতি খোদ উন্নত দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। বৈশ্বিক মহামারি কভিডের সময় সবচেয়ে বড় গুজব ছিল চীনের লোকজন বাদুড়ের স্যুপ খায়, সেই কারণেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, গুজব হলো জনসাধারণ-সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোনো বর্ণনা বা গল্প। আমাদের দেশে ‘গল্পগুজব’, ‘গালগল্প’, ‘আষাঢ়ে গল্প’—এই শব্দগুলো থেকেও বোঝা যায়, এখানে গুজবের অস্তিত্ব ভালো মতোই রয়েছে।

অতীতে যখন প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না, তখন মুখে মুখে গুজব প্রচার করা হতো। কিন্তু এখন প্রযুক্তির কারণে লিখিতভাবে ও দ্রুত গুজব প্রচারিত হয়।

গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘রিউমার সাইকোলজি’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, যখন কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখনই গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়। ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং মেলইনফরমেশনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং অ্যামপ্লিফিকেশন নেটওয়ার্কের মতো নতুন প্রযুক্তি তথ্যকে বিকৃত করার কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করেও মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয়, মূলধারার গণমাধ্যম ব্যবহার করেও অনেক সময় গুজব ছড়ানো হয়। কয়েক দশক আগে ১৯৮৭ সালে ‘ঢোলকলমি’র গুজব যখন ছড়ায়, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। তখন মূলধারার গণমাধ্যম ব্যবহার করেই এ গুজবের ডালপালা ছড়িয়েছিল।

প্রথম ছিল এ গাছের পাতা গায়ে লাগলে মানুষ মারা যায়, তারপর বলা হলো এ গাছে যে পোকা বসে তা গায়ে লাগলে বা দংশন করলে মানুষ মারা যায়। কিন্তু পরে দেখা গেল পুরোটাই ছিল গুজব। কিন্তু গুজবের হিড়িকে সারাদেশে সাধারণ মানুষ গণহারে, এমনকি প্রশাসনও ঢোলকলমি গাছ কেটে সাবাড় করেছিল।

ইতিহাসজুড়ে গুজবকে রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রচার, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলে কারসাজি ও নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য সামপ্রদায়িক উসকানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘কর্পস ফ্যাক্টরি’ গুজব ছড়িয়ে দাবি করা হয়েছিল, জার্মানরা নিজস্ব সৈন্যদের মৃতদেহ ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করছে, এটি যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডা হিসেবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। আরব বসন্তের সময় তিউনিসিয়ায় ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গুজবের দ্রুত বিস্তার ঘটতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও গুজব ছড়ানোর প্রবণতা ও এর প্রভাব ভয়াবহ। পদ্মা সেতু নির্মাণে শিশুদের মাথা লাগবে—এমন গুজবে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা রেনু নামে এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা এখনও আমরা বিস্মৃত হয়নি। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে লবণের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানুষের প্রয়োজনের অধিক লবণ কেনার হিড়িক দেখা যায়।

করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাকে পুঁজি করে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জমানো টাকা তুলে ফেলেন। পরে তথ্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে গ্রাহকরা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। ফেসবুকের কিছু পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগে ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা হয়েছিল। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা এবং ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঘটনাটি গড়িয়েছিল সামপ্রদায়িক হামলা, পুলিশের গুলি ও একজনের মৃত্যু পর্যন্ত।

যেকোনো দুর্যোগ বা সংকটকালীন সময়ে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ যেকোনো সংকটে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক এবং উদ্বেগকে বাড়িয়ে জনসাধারণের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়াও বিশ্বায়নের এই যুগে সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে। সামপ্রতিক সময়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর ব্যাপক প্রবণতা এবং এর ভয়াবহ ফলাফল লক্ষ্যণীয়, যা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও গুরুতর একটি সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি, যে কারণেই ছড়ানো হোক না কেন, ফেক নিউজ বা গুজব অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেকোনো আলোচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মাঝে দু-একটা ভুয়া খবর ভাইরাল হওয়া এখন আর নতুন কিছু নয়।

বর্তমানে সাধারণত ছবি এডিট করে অহরহ গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। মূলধারা গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় হরহামেশাই। অনেক সময় আসল ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন সময় ও স্থান যোগ করে ছবির প্রেক্ষাপট বদলে ফেলা হয়। জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় এমন বিষয়বস্তু নিয়ে মিথ্যা ও চটকদার ভিডিও তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়। এছাড়া পুরোনো ভিডিওতে বর্তমান সময়ের কথা ব্যবহার এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে একজনের চেহারায় তার আর্টিফিশিয়াল ভয়েস যুক্ত করে ডিপ ফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভুয়া ভিডিও তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়।

মূলধারার গণমাধ্যম থেকে কাল্পনিক উদ্ধৃতি, সত্য খবর পালটে ফেলা, অখ্যাত গণমাধ্যম বা ব্লগের খবর ব্যবহার করে বা কোনো গবেষণার ফলাফলের ভুল ব্যাখ্যা ও অকার্যকর তুলনার মাধ্যমেও গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে।

গুজব ছড়িয়ে কারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় তা বোঝার আগেই ঘটনার শিকার হতে হয় গুজবের ফাঁদে পা দেয়া মানুষদের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গুজবে বিশ্বাস করা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কারণ মানুষের মনের একটি অংশই চায় নেতিবাচক খবর বা গুজবে বিশ্বাস করতে।

নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী ড. পল জোসেফ গোয়েবলস বলেছিলেন, আপনি যদি একটা মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। প্রাচীনকালে মুখে মুখে গুজব ছড়ানো হতো। তারপর ছাপাখানার আবিষ্কার, প্রিন্ট মাধ্যমের আগমন এবং সংবাদপত্রের প্রচলনের মাধ্যমে গণমাধ্যম হয়ে ওঠে গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার। কালের পরিক্রমায় ইন্টারনেট তথা সোশ্যাল মিডিয়ার সময়ে এর বিস্ফোরণ ঘটে ব্যাপকভাবে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। গণমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ও প্রভাব সম্পর্কে তাই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গুজব প্রতিরোধে সরকার, জনসাধারণ এবং গণমাধ্যমগুলোকে একযোগে পদক্ষেপ নিতে হবে। গুজব শনাক্তকরণে গণমাধ্যমগুলোর নিজস্ব ফ্যাক্ট চেকার থাকা দরকার। বিকল্প উৎস থেকে তথ্য যাচাই গুজবের বিপরীতে প্রকৃত তথ্য প্রচার করে গণমাধ্যম গুজবকে প্রতিহত করতে পারে। গুজব প্রতিরোধে আরও একটি কার্যকর উপায় হলো মিডিয়া লিটারেসি বা গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা। এর ফলে একজন পাঠক বা দর্শক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে এবং সহজেই প্রকৃত সংবাদ ও গুজবকে আলাদা করতে পারবে। সরকারের আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি গুজব মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্যের ফ্যাক্ট চেকিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার, গুজব শনাক্তে কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গুজব সৃষ্টিকারীকে শাস্তির আওতায় আনার মাধ্যমে গুজব অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়