Print Date & Time : 26 August 2025 Tuesday 12:41 pm

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সাক্ষরতা

 রাশেদুল ইসলাম : বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আর্থিক সাক্ষরতা এখন আর কেবল একটি দক্ষতা নয়, এটি এক অনিবার্য চাহিদা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে প্রাথমিক আর্থিক জ্ঞানের অভাব উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে এবং দারিদ্র্যের চক্রকে আরও দৃঢ় করছে।

যদিও দেশে মাইক্রোফাইন্যান্স, মোবাইল ব্যাংকিং ও সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচির প্রসার ঘটেছে, তবুও গ্রামীণ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে এখনও প্রাথমিক আর্থিক ধারণাগুলো অনুপস্থিত। ফলে তারা অর্থ ব্যবস্থাপনা, আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবাগুলো ব্যবহার, এবং সম্পদসংক্রান্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সুতরাং গ্রামীণ জনগণের আর্থিক সাক্ষরতা কেবল উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নয়, বরং জাতীয় জীবনের অপরিহার্য শ্বাস, বিশেষত যখন আমরা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছি।

আর্থিক সাক্ষরতা কী?

আর্থিক সাক্ষরতা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি দৈনন্দিন জীবনে টাকার সঠিক ব্যবহার, হিসাব-নিকাশ জানা বা বাজেট তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে এর পরিধি অনেক গভীর। এটি হলো অর্থকে বুঝে, দক্ষভাবে পরিচালনা করে এবং সেই অর্থের মাধ্যমে নিরাপদ ও স্থিতিশীল জীবন গড়ে তোলার ক্ষমতা।

একজন আর্থিকভাবে সাক্ষর মানুষ জানেন

আয়ের সঙ্গে খরচ কীভাবে সামঞ্জস্য রাখতে হয়, কোন খাতে সঞ্চয় করা জরুরি, ঋণ নেয়া হলে কীভাবে তা ফেরত দিতে হবে, বিনিয়োগ কোথায় করলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ও মুনাফা পাওয়া যায়, আর্থিক পরিষেবা ব্যবহার করার সময় প্রতারণা বা ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। গ্রামীণ মানুষের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব আরও বহুমাত্রিক।

যেখানে নগরের মানুষ তুলনামূলকভাবে ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, সেখানে গ্রামে বসবাসকারী মানুষদের জন্য আর্থিক সাক্ষরতা একেবারেই জীবনধারার অপরিহার্য অংশ। যেমন—

মাইক্রোক্রেডিট কীভাবে নিতে হয় এবং সময়মতো কীভাবে তা পরিশোধ করতে হয়, বিকাশ বা নগদের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে নিরাপদে টাকা পাঠানো বা গ্রহণ করা, সরকারি ভাতা, কৃষি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা কীভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে আসে এবং তা ব্যবহার করার সঠিক পদ্ধতি, বিভিন্ন আর্থিক প্রতারণা থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়।

বাংলাদেশের গ্রামীণ আর্থিক বাস্তবতা: বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক। মানুষ প্রায়ই উচ্চ সুদে গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, যা তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার দূরত্ব, জটিল কাগজপত্র ও আর্থিক সচেতনতার অভাবের কারণে গ্রামীণ মানুষ আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যদিও মাইক্রোফাইন্যান্স কিছুটা সুবিধা এনেছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য, তবে অনেক সময় ঋণের শর্ত বা সুদের হার ভালোভাবে না বুঝেই ঋণ নেয়া হয়। এতে করে একাধিক ঋণের বোঝা তৈরি হয় এবং মানুষ অস্থির আর্থিক অবস্থায় পড়ে যায়।

গ্রামে আর্থিক সাক্ষরতার পথে প্রধান বাধাগুলো

১. শিক্ষা ও ডিজিটাল জ্ঞানের অভাব

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বা অল্পশিক্ষিত। ফলে বাজেট তৈরি, ঋণ ব্যবস্থাপনা কিংবা সঞ্চয় পরিকল্পনার মতো মৌলিক ধারণা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট থেকে যায়। একই সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল জ্ঞানও তাদের নেই। এর ফলে আধুনিক আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তারা তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে না।

২. সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্য

গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত সামাজিক মানসিকতা ও লিঙ্গ বৈষম্য নারীদের আর্থিক সাক্ষরতা অর্জনের পথে একটি বড় বাধা। অধিকাংশ পরিবারে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পুরুষ সদস্যদের হাতে সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে নারীরা অর্থ ব্যবস্থাপনা, সঞ্চয় কিংবা বিনিয়োগে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। অথচ নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়লে পারিবারিক আর্থিক স্থিতিশীলতা অনেক বেশি মজবুত হয়।

৩. জটিল ভাষা ও মাধ্যম

অধিকাংশ আর্থিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এমন ভাষায় ও মাধ্যমে পরিচালিত হয়; যা গ্রামীণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। কঠিন পরিভাষা, শহরমুখী উদাহরণ, তাদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা শেখার আগ্রহ হারায় এবং আর্থিক সাক্ষরতা কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়ে।

 

কেন এখন আর্থিক সাক্ষরতা আরও জরুরি?

আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রা যেমন পরিবর্তন করছে, তেমনি অর্থ ব্যবস্থাপনার ধরনেও নিয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগে যেখানে নগদ অর্থই ছিল প্রধান ভরসা, এখন সেখানে ডিজিটাল মাধ্যম প্রাধান্য পাচ্ছে।

১. নগদ লেনদেন থেকে ডিজিটাল সেবায় রূপান্তর

গ্রামে হোক বা শহরে—আজকে মানুষ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে, বিল পরিশোধ করছে কিংবা ব্যবসার মূলধন লেনদেন করছে। কিন্তু এসব সেবা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে আর্থিক জ্ঞানের পাশাপাশি ডিজিটাল সাক্ষরতাও জরুরি। না হলে সহজেই প্রতারণা বা ভুল ব্যবহারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

২. সরকারি অনুদান ও ভাতা ব্যবস্থার পরিবর্তন

সরকারি ভর্তুকি, বয়স্ক ভাতা কিংবা কৃষি সহায়তার মতো সুবিধাগুলো এখন ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে সরাসরি উপকারভোগীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক গ্রামীণ মানুষ জানেন না কীভাবে এ টাকা উত্তোলন করতে হয়, কিংবা কীভাবে নিরাপদে ব্যবহার করতে হয়। তাই এই সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে আর্থিক সাক্ষরতা অপরিহার্য।

৩. রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার

রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনীতির একটি বড় ভিত্তি। কিন্তু অনেক পরিবারই এ টাকা কেবল খরচ করে ফেলে, সঞ্চয় বা বিনিয়োগে ব্যবহার করতে জানে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতা তৈরি হয় না। আর্থিক সাক্ষরতা থাকলে রেমিট্যান্সকে শুধু খরচ নয়, বরং সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।

৪. ডিজিটাল সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ

ব্যাংক অ্যাপ, মোবাইল সঞ্চয় স্কিম কিংবা ডিজিটাল বিমার মতো নতুন আর্থিক পণ্যগুলো এখন মানুষের হাতের নাগালে। কিন্তু এগুলোর সঠিক ব্যবহার জানাই মূল চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজনীয় আর্থিক জ্ঞান ছাড়া এসব সুযোগ কেবল অল্পসংখ্যক মানুষই কাজে লাগাতে পারবে আর বাকিরা পিছিয়ে থাকবে।

 

আর্থিক অজ্ঞতার বাস্তব পরিণতি

*     ভুলভাবে ঋণ নেয়া ও একাধিক ঋণের ফাঁদে পড়ে পরিবারগুলো ক্রমাগত ঋণচক্রে জড়িয়ে পড়ে।

*     জরুরি সঞ্চয় তৈরি না হওয়ায় বিপদে পড়লে টিকে থাকা কঠিন হয়।

*     প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই কষ্টার্জিত অর্থ হারায়।

*     সব মিলিয়ে, আর্থিক অজ্ঞতা পরিবার ও গ্রামের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।

 

আর্থিক সাক্ষরতার সুফল

আর্থিক সাক্ষরতা গ্রামীণ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে—

*     সঞ্চয় ও খরচের সচেতনতা তৈরি হয়।

*     নারী ও তরুণরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারে।

*     কৃষকরা উন্নত কৃষিপদ্ধতি ও সঠিক উপকরণ নির্বাচন করতে পারে।

*     আর্থিকভাবে সচেতন গ্রামগুলো হঠাৎ দামে ওঠানামা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সংকটে টিকে থাকতে পারে।

 

গ্রামীণ জনগণের আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সচেতন ও দক্ষ করে তুলতে হলে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার বদলে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। এর জন্য বিভিন্ন পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।

*     এনজিও, ব্যাংক ও সরকারের সমন্বয়:

শুধু সরকার বা ব্যাংকের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এনজিওগুলো স্থানীয় পর্যায়ে সরাসরি মানুষের সঙ্গে কাজ করে, ব্যাংকগুলো আর্থিক সেবা দেয় এবং সরকার নীতিনির্ধারণ করে। তাই এই তিন পক্ষের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমেই গ্রামীণ মানুষকে কার্যকরভাবে আর্থিকভাবে সক্ষম করা সম্ভব।

*     শিক্ষা কর্মসূচির প্রসার: স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে ব্যবহার করে আর্থিক সাক্ষরতাবিষয়ক শিক্ষা কর্মসূচি চালাতে হবে। স্থানীয় ভাষা ও বাস্তব জীবনের উদাহরণ ব্যবহার করলে মানুষ সহজে শিখতে ও গ্রহণ করতে পারবে।

*     ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজ উপস্থাপন:

ফেসবুক, ইউটিউব বা মোবাইলঅ্যাপের মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক, অডিও কনটেন্ট ইত্যাদি তৈরি করে আর্থিক জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। সহজ ও বোধগম্য উপস্থাপন মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে।

*     নারী ও প্রান্তিক জনগণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ: গ্রামীণ সমাজে নারীরা আর্থিক সিদ্ধান্তে পিছিয়ে থাকে এবং প্রান্তিক জনগণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই তাদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ, সচেতনতা কার্যক্রম ও সহজলভ্য সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। এতে পরিবার ও সমাজ উভয়ই আর্থিকভাবে শক্তিশালী হবে।

 

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়