মনিরুল হক : বাংলাদেশের প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে তাইওয়ানি ব্র্যান্ড আসুসের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বিশেষ করে গেমিং পিসির ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডটি প্রায় একক আধিপত্য ধরে রেখেছে। উচ্চমূল্যে এই ডিভাইস কিনলেও প্রত্যাশিত বিক্রয়োত্তর সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। দেশের একমাত্র পরিবেশক গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সেবায় নৈরাজ্য ইতোমধ্যে ভোক্তাদের কাছে ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছে। ওয়ারেন্টির নামে প্রতারণা, পণ্যের দায় এড়াতে নানা অজুহাত, দক্ষ কারিগরি সহায়তার ঘাটতি এবং গ্রাহকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এখন নিত্যকার বাস্তবতা। শেয়ার বিজ-এর অনুসন্ধানে একাধিক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতায় সেই চিত্র আরও স্পষ্ট ওয়ে ওঠে।
মিরপুর এলাকায় থাকেন ভিডিও এডিটর মিজানুর রহমান। তিনি আসুসের বিক্রয়োত্তর সেবা না পাওয়া ভুক্তভোগীদের একজন। ব্যয়বহুল অঝটঝ জঙে ঝঞজওঢ ই৭৬০-অ অেগওঘে ডওঋও মাদারবোর্ডসহ পুরো পিসি তিনি কিনেছিলেন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ৪ ঝঃধৎ ওঞ থেকে। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহে মাদারবোর্ডে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় এবং তার পেশাগত কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। দোকানের প্রতিনিধি সৈয়দ আশরারুল শান্ত ওয়ারেন্টির নিশ্চয়তা দিয়ে তাকে প্রথমে কলাবাগান ডলফিন গলির আসুস সার্ভিস সেন্টারে পাঠান, যেখানে গিয়ে তিনি দেখেন আসুসের বিক্রয়োত্তর সেবার প্রকৃত স্বরূপ।
তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, সার্ভিস সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে পণ্য রিসিভ করতে রাজি হলেও পরে মাদারবোর্ডের ঈচট সকেটে সামান্য বেন্ড পিন এবং একটি ক্ষুদ্র আঁচড়কে ওয়ারেন্টি বাতিলের অজুহাত হিসেবে দেখান। মিজান যুক্তি দিলেও তাকে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে শেষ পর্যন্ত রিসিভই করা হয়নি পণ্যটি। এই পুরো প্রক্রিয়ায় দুর্ব্যবহার ও অবমাননাকর ভাষার শিকার হন তিনি। মিজানের মতে, সার্ভিস সেন্টারের আচরণে সেবা ছিল না, ছিল হয়রানি। তিনি বলেন, সার্ভিস সেন্টারের কর্মীদের মাইন্ডসেট হলো নানা অজুহাতে তার কাজটি না করা। আর সর্বশেষ সেটিই তারা করেছিলেন।
হতাশ মিজান পরদিন আগারগাঁওয়ের গ্লোবাল ব্র্যান্ড সার্ভিস সেন্টারে গেলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠে। তিনজন আলাদা কর্মী তাকে বারবার একই জিজ্ঞাসাবাদে ফেলেন এবং নতুন নতুন কারণ দেখিয়ে পণ্যটি রিসিভ করতে অস্বীকৃতি জানান।
মিজান জানান, তাদের কথার ভাষা ছিল এমন, যেন তিনি সার্ভিস নিতে নয়, অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করানোর পর তাকে জানানো হয়, তিনি যে দোকান থেকে কিনেছেন, সেখানেই জমা দিতে হবে। ফলে তিনি শূন্য হাতে এবং ভীষণ মানসিক চাপ নিয়ে ফিরে আসেন।
এই হয়রানির ফলে মিজানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভিডিও ক্লায়েন্টের কাজ সময়মতো জমা দিতে না পারায় আর্থিক ক্ষতিও গুনতে হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ভোক্তার সময়, অর্থ ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গ্লোবাল ব্র্যান্ডের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তার মতে, যারা গ্রাহকদের সঙ্গে এমন আচরণে অভ্যস্ত, তারা মনে করে গ্রাহকের অধিকাংশই প্রতিবাদ করতে পারবেন না, আর সেই সুযোগই নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।’
শেষ পর্যন্ত মিজান অনলাইনে খোঁজ নিয়ে শেওড়াপাড়ার কিউ-ফিক্স সার্ভিস সেন্টারে যান। আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র ১০ মিনিটেই সেখানে দক্ষ কারিগর সমস্যাটি নির্ণয় ও সমাধান করেন এবং মাদারবোর্ড সম্পূর্ণ সচল অবস্থায় ফেরত দেন।
এতে প্রমাণিত হয়, কম্পিউটারটির এমন কোনো অসুবিধা ছিল না যে ওয়ারেন্টি থাকা সত্ত্বেও তা এড়ানোর জন্য নানা ধরনের যুক্তি খুঁজতে হবে। বরং সার্ভিস সেন্টার ইচ্ছাকৃতভাবেই দায় এড়িয়েছে।
মিজান বলেন, ‘একজন গ্রাহক হিসেবে প্রতারণার শিকার হয়ে আমি ক্লান্ত ও হতাশ। আমি আশা করি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্বসহ তদন্ত করবে।’
আসুসের বিক্রয়োত্তর সেবার হয়রানির এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। উত্তরায় বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানভীরুল হক জানান, তিন মাস ব্যবহƒত আসুস গ্রাফিক্স কার্ড জমা দিতে গেলে প্রথমেই অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে থেকে কেনা হয়েছে কি না, সে সন্দেহ করা হয়।
সাভারের শিক্ষক নাসির উদ্দিন অঝটঝ ঢ৫১৫ ল্যাপটপের স্ক্রিন সমস্যার বিষয়টি নিয়ে গেলে ‘ডিজাইন ফ্ল’র অজুহাতে সার্ভিস দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ফলে তিনিও কোনো সমাধান ছাড়াই সার্ভিস সেন্টার থেকে ফিরে আসেন।
গ্লোবাল ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সার্ভিস কর্মী জানান, সামান্য আঁচড় দেখলেই পণ্য রিসিভ না করার নির্দেশনা থাকে। তার মতে, এটি ব্যবসায়িক ভুল নীতি এবং ব্র্যান্ডের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে।
গ্রাহকদের অভিযোগের স্রোত বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সার্ভিস আচরণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। ব্র্যান্ডের বিপণন প্রচারণার বিপরীতে বাস্তব অভিজ্ঞতা এতটাই ভিন্ন যে নতুন ক্রেতারাও এখন দুবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রযুক্তি খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় বাজারে আস্থা টিকিয়ে রাখতে গ্লোবাল ব্র্যান্ডকে দ্রুত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ জনবল নিয়োগ, গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নীতিমালা তৈরি এবং সার্ভিস নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। নতুবা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবেও আসুসের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আসুস বাংলাদেশের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার আল ফুয়াদ শেয়ার বিজকে বলেন, এখানে হয়তো কোনো ভুল বোঝাবুঝি আছে, কারণ আসুস বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্যের ওয়ারেন্টি নিশ্চিত করতে কাজ করছে। বাংলাদেশেও আসুসের বিক্রয়োত্তর সেবার যথেষ্ট সুনাম আছে। আমাদের সার্ভিস সেন্টারে প্রতিনিয়ত এসব বিষয়ে নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমরা সুনির্দিষ্ট পলিসি অনুসরণ করেই এই সেবা দিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, ওয়ারেন্টি না থাকলেও আমাদের সার্ভিস সেন্টারে পণ্যের সার্ভিসিং সেবা পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আলাদা করে চার্জ বা যন্ত্রাংশের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ইলেকট্রনিক আইটেমে প্রতিনিয়ত এ রকম অভিযোগ আমরা পাচ্ছি এবং ভোক্তা অধিদপ্তরে জরিমানাও করছে। ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি ঠিকমতো মেইনটেন করছে না তারা। পণ্য কেনার পরে আফটার সেলস সার্ভিস ঠিকমতো পাচ্ছে না। এতে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার আসুসও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ মানুষ অন্য ব্র্যান্ডের পণ্যে সুইচ করছে। যখন ওখান থেকে সেলস সার্ভিসটা পাবে না, তখন কিন্তু কেউ পরবর্তী সময়ে ওই কোম্পানির পণ্য কিনতে চাইবে না। তাতে কোম্পানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘ডিলারশিপের ক্ষেত্রে একটা নজরদারি থাকা উচিত। আসুসেরও একটা নিজস্ব নজরদারি থাকা দরকার। তাহলে গ্রাহকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যাবে, অথবা তারা অন্য ডিলারকে কাজটি দেবে। এটা আমরা অনেক আগে থেকেই দেখছিÑএরকম কম্পিউটার বা কম্পিউটারের এক্সেসরিস অথবা ইলেকট্রনিক আইটেমে ফাঁকিবাজির হিসাব কিন্তু অনেক বেশি।’
মিজান বলছেন, প্রযুক্তিপণ্য কেনার মূল উদ্দেশ্য সেবা গ্রহণের নিরাপত্তা পাওয়া। সেখানে যদি ওয়ারেন্টির নামে প্রতারণা হয়, তবে তা বন্ধ করা জরুরি। তার মতে, বাংলাদেশের গ্রাহকেরাও প্রাপ্য সম্মান ও সেবা পাওয়ার যোগ্য। তিনি আশা করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারিতে এই নৈরাজ্য শিগগিরই বন্ধ হবে।
আগারগাঁওয়ের গ্লোবাল ব্র্যান্ড সার্ভিস সেন্টারে কথা বলে জানা যায়, তারা আসুসের শুধু ওয়ারেন্টি থাকা ল্যাপটপগুলোই সার্ভিসিং করে থাকে। আর যেসব ল্যাপটপের ওয়ারেন্টি থাকে না, সেগুলো তারা তাদেরই আর একটি প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যান্ড সলুশন’-এ পাঠিয়ে দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ‘গ্লোবাল ব্র্যান্ড’ এবং ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যান্ড সলুশন’-এ সার্ভিস নেয়া গ্রাহকের উপস্থিতি খুবই কম। উপস্থিত গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্লোবাল এই ব্র্যান্ডটির বিক্রয়োত্তর সেবা গ্রহণের জটিলতার কারণে অনেকেই এখন আর সার্ভিস সেন্টারে আসে না।
জানা গেছে, আসুসের নীতিমালা অনুযায়ী, বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে তাদের পণ্য কিনলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেকোনো দেশে তাদের সার্ভিস সেন্টার থেকে বিক্রয়োত্তর সেবা পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে গ্লোবাল নীতিমালা উপেক্ষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন এর গ্রাহকরা।
