শেয়ার বিজ ডেস্ক : সারাদেশে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে জ্বরের প্রকোপ। আক্রান্ত হচ্ছে ছোট-বড় সবাই। সিজনাল এই জ্বরে কাবু হচ্ছেন আক্রান্ত রোগীরা। জ্বরের সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথাসহ নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের ভুগতে হচ্ছে এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। জ্বর ভালো হওয়ার পরও শারীরিক ক্লান্তি থাকছে দীর্ঘদিন, যার ছাপ পড়ছে দৈনন্দিন কাজে। ঠিকমতো খেতে পারছেন না অনেকেই। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, শ্বাসকষ্টজনিত রোগী এবং যাদের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের বেশির ভাগই সাধারণ মৌসুমি জ্বর। কেউ কেউ করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিংবা টাইফয়েডে আক্রান্ত। রোগীদের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে দুই থেকে থেকে তিন দিন স্থায়ী জ্বর, গলাব্যথা, হালকা কাশি, মাথা ও পুরো শরীর ব্যথা, দুর্বলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা শ্বাসকষ্ট।
এমনই একজন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী জিসান আহমেদ। জুলাই মাসের শুরুর দিকে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০ দিন বিছানায় শুয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রাত ৯টা-১০টার দিকে শরীরটা হালকা খারাপ লাগছিল। পরে শুয়ে পড়েছি। ঘুমানোর দুই-তিন ঘণ্টা পর আমার শরীরে জ্বর আসে। জ্বরের তীব্রতাটা একটু বেশি ছিল। সেই সঙ্গে পুরো শরীর প্রচণ্ড ব্যথা, যার কারণে ভয়ও পেয়েছিলাম।’
জিসান আহমেদ বলেন, ‘অন্যান্য সময়ে জ্বর কিছুক্ষণ পরপর চলে যেত, আবার আসত। এবার টানা জ্বর ছিল, জ্বর থাকাকালে হাঁটব, সেই শক্তিও শরীরে পেতাম না। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হতো। মাঝে মাঝে মনে হতো শরীরের কোনো শক্তি নেই। জ্বরের সময়টা খুবই ভয়াবহ ছিল। ভাবছিলাম ডেঙ্গু হবে, কিন্তু ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়া টেস্ট করার পর এগুলো নেগেটিভ এসেছে। অর্থাৎ সাধারণ জ্বর।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড ও মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষ। দুই থেকে তিন দিনের জ্বর নিয়ে আসছেন রোগীরা। একজনের জ্বর হলে পরিবারের অন্যরাও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। উপসর্গও প্রায় একই রকম। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ ভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বরে। তাদের পরামর্শ, হালকা উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মাস্ক পরা ও গরম তরল খাবার খেতে হবে।
রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন জ্বরে আক্রান্ত ৫০০-৬০০ রোগী আসছে হাসপাতালটিতে। এর মধ্যে বেশ কিছু থাকে গুরুতর রোগী, যাদের অনেকে নানা রোগে আক্রান্ত ও বৃদ্ধ। প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে ১৫-২০ জন। জুলাই মাসে জ্বরে আক্রান্ত রোগী আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘এক মাস ধরে জ্বরে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য সময়ে জ্বরে আক্রান্ত রোগী যা আসত, এখন কয়েকগুণ বেড়েছে। যাদের ভর্তি নেওয়ার মতো, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। আর যাদের চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিলে হবে, তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আগত রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, গত জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনে বহির্বিভাগে শুধু মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন সাত হাজার ১৮৪ জন। পরের ১২ দিন (১২ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত) চিকিৎসা নিয়েছেন আট হাজার ২৭৪ জন। সেই হিসাবে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীর হার বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এছাড়া গত ১ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসব হাসপাতালে ৭৪ হাজার ২৮০টি বিভিন্ন ভাইরাস জ্বরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ১২ দিনে ৩৭ হাজার ৮৩টি পরীক্ষা করা হয়। এই কয়েক দিনে দিনপ্রতি গড়ে ৩ হাজার ৯০ জনের পরীক্ষা করা হয়। তবে পরবর্তী ১২ দিনে ৩৭ হাজার ১৯৭টি পরীক্ষা করা হয়। পরের ১২ দিনে দৈনিক ১১৪টি পরীক্ষা বেশি করা হয়েছে। এই কয়েক দিনে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৯৯টি পরীক্ষা বেশি করা হয়। পরীক্ষার হার বেড়েছে প্রায় শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে এদের বাইরে অসংখ্য রোগী বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তাদের তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারুক আহাম্মদ বলেন, আমরা দিনে গড়ে এক হাজার ২০০ রোগী দেখছি, যার একটি বড় অংশ ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। প্রায় সবারই জ্বর, কাশি, শরীরব্যথা ও দুর্বলতা রয়েছে। রোগী সামলানো ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সংকটে পড়ছি। জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়, বরং এটি রোগের একটি লক্ষণ বা উপসর্গ। অনেক কারণে জ্বর হতে পারে। সবচেয়ে কমন হলো ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়া বা সর্দি-কাশির কারণে জ্বর। এর বাইরে শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ হলে, অর্থাৎ ইনফেকশন হলে জ্বর হতে পারে। এছাড়া টিকা নিলে, ফোড়া বা টিউমার হলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হলে, পিরিয়ডের কারণে, আকস্মিক ভয় পেলে বা মানসিক আঘাত পেলেও জ্বর হতে পারে।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ তলায় ডেঙ্গু কর্নারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই হাসপাতালে ১ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৪৫ জনে। এর মধ্যে প্রথম ১৪ দিনে ভর্তি ৭২৫ জন এবং পরের ১৪ দিনে ভর্তি হয়েছেন ৮২০ জন। হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, সাধারণ ভাইরাল জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ডেঙ্গু মিলিয়ে রোগীর চাপ আগের তুলনায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই হিসাব শুধু সরকারি হাসপাতালের হলেও রোগীর চাপের বড় অংশই চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে, যাদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সামনে আসছে না। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী এখন হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, যাদের হিসাব সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে আসা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, দুর্বলতাÑএই চারটি উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। এগুলো সাধারণ ভাইরাল ইনফেকশনের লক্ষণ হলেও পাশাপাশি ডেঙ্গু এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণও লক্ষ করা যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। আমাদের ধারণা, একাধিক ভাইরাস এখন একসঙ্গে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা না নিয়েই জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন, এতে ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জুলাই মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু ও অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের কারণে রোগীর চাপ গত জুন মাসের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী আসছেন, যাদের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, আবার কেউ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সাধারণ ভাইরাল ফ্লুতে ভুগছেন।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘যখন কারও জ্বর হয়, প্রথম কাজ হচ্ছে জ্বর কমানো। রোগীকে প্যারাসিটামল (যেমন নাপা ইত্যাদি) খেতে হবে। অ্যাসপিরিন দেয়া যাবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে যদি তারা প্যারাসিটামল সিরাপ খেতে না পারে, তাহলে প্যারাসিটামল সাপোজিটরি দিতে হবে। প্যারাসিটামল সাপোজিটরি দুই ধরনের পাওয়া যায়Ñএকটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এবং অন্যটি শিশুদের জন্য।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কপালে পানিতে ভেজানো কাপড় বা স্পঞ্জিং করতে হবে এবং হাত-পায়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এতে শরীরের তাপমাত্রা কমে যাবে। এই সময় রক্ত পরীক্ষা করানো দরকার রোগী ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া অথবা করোনায় আক্রান্ত কি না তা জানতে। যদি রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, রোগী এসব সংক্রমণের যে কোনো একটিতে আক্রান্ত, তাহলে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীকে প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। সবশেষে মনে রাখতে হবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, পরামর্শ হলো সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। বের হলে বাচ্চাকে মাস্ক পরাতে হবে। অভিভাবকদেরও মাস্ক পরতে হবে। বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। রোদের মধ্যে খেলতে হবে। প্রচুর ফলমূল খেতে হবে। ঘরে বসিয়ে রাখা যাবে না। বাচ্চাদের বাহিরমুখী করাতে হবে। আর বাইরে বের হতে হলে মাস্ক পরাতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এ-জাতীয় সর্দি-জ্বরে যারা আক্রান্ত হবে, তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি ও তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। তাজা ফলমূল ও শাকসবজি অত্যন্ত উপকারী। যদি তীব্র শরীর ও মাথাব্যথা হয়, তাহলে শুধু প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। চিকিৎসককের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না।’

Print Date & Time : 2 August 2025 Saturday 7:57 pm
ঘরে ঘরে জ্বরের প্রকোপ উপসর্গে কাবু আক্রান্তরা
জাতীয়,পত্রিকা,শীর্ষ খবর,শেষ পাতা,স্বাস্থ্য ♦ প্রকাশ: