নিজস্ব প্রতিবেদক : বহু বছরের নানা সংকট ও অস্থিরতার পর দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা, বিদেশে অর্থপাচার, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপÑসব মিলিয়ে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তার প্রভাব এখন অনেকটাই কমছে। শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, যা অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশন এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে উন্নতির ধারা স্পষ্ট। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অগ্রগতি ধরে রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবসা সহজীকরণের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা জরুরি। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন কমে এসেছে। এর ফলে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
গত ১২ আগস্ট মালয়েশিয়ায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অতীতে স্বৈরশাসনের সময় ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছিল, যা আর্থিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়। তবে প্রবাসী আয়ের জোরে অর্থনীতি এখন শক্ত অবস্থানে ফিরছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, ব্যালান্স অব পেমেন্টসে উন্নতি এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা অর্থনীতিকে সহায়তা করছে।
একসময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ২০২৪ সালে নেমে এসেছিল ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে, যা অর্থনীতিবিদদের মতে একটি বড় অর্জন।
রপ্তানি খাতেও উন্নতি স্পষ্ট। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক ছাড়াও ওষুধ, চামড়া, প্রকৌশল পণ্য ও আইসিটি খাতে প্রবৃদ্ধি এসেছে।
তবে মূল্যস্ফীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৫ সালের জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা এক বছর আগে ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। তবে গত জুলাইয়ে সামান্য ঊর্ধ্বগতি আবার উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, লক্ষ্যমাত্রা ছয় শতাংশে নামানো সম্ভব হয়নি, তবে হার সহনীয় পর্যায়ে আছে।
জুলাইয়ের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৫ পয়েন্টে, যা শিল্প, সেবা ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘আমরা অস্বস্তি থেকে কিছুটা স্বস্তিতে এসেছি, কিন্তু এখনো পুরোপুরি ভালো অবস্থায় পৌঁছাইনি।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ব্যাংক খাতে অতীতে যে মাত্রায় লুটপাট হয়েছে, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায়নি। দেশের অর্থনীতি আইসিইউ থেকে এইচডিইউতে পৌঁছেছে। আমরা খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছি। তবে অর্থনীতি এখনো নিরাপদ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়নি। স্বস্তি এসেছে অর্থনীতিতে, কিন্তু এখনো তৈরি হয়নি আত্মতুষ্টির জায়গা। দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারা থেকে আইসিইউ হয়ে এখন কেবিনে ফিরছে। এটি কবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেÑএমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখনো কেবিনে ফেরার মতো অবস্থায় নেই। আর গরিব দেশের অর্থনীতি কেবিনে ফিরবে না। পেয়িং বেড বা ওয়ার্ডে ফিরবে, তারপর বাড়ি ফিরবে।’
এদিকে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও অস্থিরতার কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাটের কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এ কারণে বেসরকারি খাতের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঋণের জোগান দিতে পারছে না।
জানা গেছে, ঋণপ্রবাহ কমার আরও একটি কারণ হচ্ছেÑচড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। চার বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও ওই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলে সুদের হার আগে যেখানে ছিল ৮ থেকে ৯ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। এসব কারণে শিল্প খাতের মন্দা কাটছে না।
অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারা বজায় থাকলেও বিনিয়োগ খাতের দুর্বলতা, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো অতিক্রমযোগ্য চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টাই এই অগ্রগতিকে স্থায়ী করতে পারে।