শেখ শাফায়াত হোসেন : কনস্টেবল হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত সাদিকুর রহমান সবুজ। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী। সম্প্রতি সেখানে একতলা পাকাবাড়ির কাজ শেষ করেছেন। বাড়িঘর ঝলমল করছে লাল-নীল আলোয়। বাড়ি বানাতে ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে বলে দাবি তার। ঘরে লাখ টাকা দামের খাট। ফলফলাদি খাওয়ার পোস্ট করেন ফেসবুকে।
সবুজের এমন জৌলুস চোখে পড়ছে এলাকার অনেকেরই। তাদের ধারণা, ঘুসের টাকায় এসব করছেন ওই কনস্টেবল।
সম্প্রতি ২০০৩ মডেলের একটি টয়োটা করোলা প্রাইভেট গাড়ি চালাতে দেখা যাচ্ছে সবুজকে। ওই গাড়িতে স্ত্রীকে চড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও দেন, ক্যাপশনে লেখেন, ‘বউ আমার অবাক’।
অথচ ওই গাড়ি তার বউয়ের নামে কিনেছেন বলে দাবি করেন সবুজ। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘পুরোনো গাড়ি ১০ লাখ টাকায় কিনেছি। এ জন্য ঋণ করতে হয়েছে। মাসে মাসে বেতনের টাকা থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করি।’
জানা গেছে, কনস্টেবল সবুজের সৎমায়ের সংসারে বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন। সবুজ বলেন, এ কারণে বাবা আলাদা করে জমিতে বাড়ি বানাতে সহযোগিতা করেছেন।
এদিকে সুবজের স্ত্রীর নামে গাড়ি কেনার কারণে সবুজকে খুব বেশি আয়কর দিতে হচ্ছে না। বর্তমানে তিনি জিরো আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন বলে জানা গেছে।
গাড়ির ঋণ পরিশোধ করার পর সবুজ বেতনের ২০ হাজার টাকার মতো হাতে পান বলে দাবি করেছেন। এই টাকা দিয়ে প্রাইভেট গাড়ি মেইনটেইন হয় কি নাÑজানতে চাইলে সবুজ বলেন, গ্রামে ক্ষেতখামার করার জমিও আছে তার। তা থেকে খাওয়া-দাওয়ার চাল, শাকসবজি হয়ে যায়। কোনো কিছু কেনা লাগে না। এ কারণে ঋণ করে এই গাড়ি কিনেছেন বলে দাবি করেন সবুজ।
সবুজের বাবা আব্দুর রহিম ভুইয়া ওরফে বাদশা ভুইয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জামালপুরের মহাদান ইউনিয়নের মেম্বার নির্বাচন করেছিলেন। সেই সুবাদে জামালপুর-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ‘টাকলা মুরাদ’ নামে পরিচিত ডা. মুরাদ হাসানের সঙ্গে ছিল সবুজদের পরিবারের সুসম্পর্ক। ফলে বিভিন্ন সময় সবুজকে ডা. মুরাদের সঙ্গে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগমধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায়।
আরও জানা যায়, সবুজের বাবা মামলার আসামি হলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। মেম্বার নির্বাচন করে ভোটে না জিতেও মেম্বার ডিক্লেয়ার করেছিল। পরে এ-সংক্রান্ত মামলায় হেরে যান তার বাবা।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্দোলন দমাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু, চোখ হারিয়ে অন্ধত্ববরণ করতে হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে।
৫ আগস্টে ক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে বেশ কয়েকটি থানার পুলিশের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এর পরপরই পুলিশের কিছু কর্মী কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। সেই সময় সবুজ তার ফেসবুক পেজে কর্মবিরতির পোস্ট শেয়ার করে। তাতে মন্তব্যের ঘরে ‘আর চাকরি করবেন না’ বলেও প্রতিউত্তর করতে দেখা যায় সবুজকে।
তবে পরিস্থিতি শান্ত হলে আবারও কাজে ফেরেন সবুজ। বর্তমানে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডির সাইবার ইউনিটে কনস্টেবলের কাজ করছেন তিনি।
কিছুদিন আগেও তাকে একটি দামি মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়। তবে সেই মোটরসাইকেলটি তিনি বিক্রি করে গাড়ি কিনেছেন বলে দাবি সবুজের। এ বিষয়ে সবুজ বলেন, ‘আমার পা দুর্ঘটনায় এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত যে, আমার আর প্রাইভেট গাড়ি না ব্যবহার করে উপায় নেই। কারণ আরেকবার দুর্ঘটনা ঘটলে এই পা আর সারবে না।’
তবে গ্রামবাসীরা বলছেন ভিন্ন কথা। সরিষাবাড়ীর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটরসাইকেল এখনও বিক্রি করেননি তিনি। তাছাড়া এলাকায় এখনও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন সবুজ ও তার বাবা। ছেলের পুলিশ পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে এলাকার অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের চাপে রাখতে চেষ্টা করছেন তার বাবা। স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহার করে মাস দুয়েক আগে তুচ্ছ ঘটনায় তিনজন তরুণকে বাড়ি এনে বেঁধে রাখেন সবুজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরিষাবাড়ীর বেশ কয়েকজন এলাকাবাসী শেয়ার বিজকে বলেন, সবুজের বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, হুমকি-ধমকি দিয়ে টাকা নেয়া, চাকরি দেয়ার কথা বলে টাকা নেয়া, মুরাদ হাসানের কাছের লোক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, বাবার মেম্বার নির্বাচনে প্রভাব খাটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল।
বর্তমানে সবুজ ফেসবুকে বেশ সরব। নিয়মিত পোস্ট দেন। কখনও কখনও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন পোস্টও দেন। সম্প্রতি ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়ার এক বক্তব্য নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল চলছিল, তখন সবুজের পরিচালিত ফেসবুক পেজ (সবুজ জাহান) থেকে লেখেন, ‘নীলা মার্কেটে কে কে হাঁসের মাংস দিয়া খাইতে যাবেন হাত তোলেন। না পাইলে কিন্তু ওয়েস্টার্নে যামু। শুভ রাত্রি।’
এ বিষয়ে সবুজ বলেন, ‘আমার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কিছু ডলার আয় করার সুযোগ আছে। এ কারণে পোস্টটি দিয়ে ভেবেছিলাম ভালো দর্শক পাওয়া যাবে। তবে সরকারি চাকরিতে থেকে এ ধরনের পোস্ট দেয়া ঠিক হয়নি। আমি পোস্টটি ডিলিট করে দেব।’
তিনি দাবি করেন, ঘুসের টাকায় তিনি গাড়ি-বাড়ি করেননি। তার প্রশ্ন, একজন কনস্টেবলকে মানুষ কেন ঘুস দেবে। তিনি বলেন, আমার কাজ পুলিশের বড় অফিসাররা যা নির্দেশ করবে, তা-ই করা। যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানে যাওয়া। দাঁড়িয়ে থাকতে বললে দাঁড়িয়ে থাকা। আমার মতো ক্ষুদ্র কনস্টেবলকে বড় অঙ্কের টাকা ঘুস দেয়ার কোনো কারণ দেখি না।

Discussion about this post