ড. শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস বদলাতে নয় বরং এর ঢেউ লেগেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতে। স্বৈরাচার হাসিনা গত ১৭ বছরে দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে যার মধ্যে অন্যতম ব্যাংকিং সহ অন্যান্য আর্থিক খাত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক, বিমা ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (ঘইঋও) যে ধরনের সংস্কার ও পুনর্গঠন শুরু হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রভাব ফেলছে।
১. অর্থনৈতিক ও মাক্রোচিত্র: মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ ও প্রবৃদ্ধি
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশে অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনায় নতুন নীতি সূচিত হয়েছে। তবে মাপকাঠি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ, বাজেট ও প্রবৃদ্ধির চিত্র মোটেই অনুকূল নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে জিএসপি ভিত্তিক সূচিতে দামের পরিবর্তন বা ‘ঢ়ড়রহঃ-ঃড়-ঢ়ড়রহঃ রহভষধঃরড়হ ৎধঃব’ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের আগস্টে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অর্থাৎ গত বছরে তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে এটি এখনও লক্ষসীমার অনেক বেশি। মাসিক গড় হিসেবে (গত ১২ মাসের গড়) মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে প্রায় ৯ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ রূপে সংকলিত হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি এখনও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও ব্যয়ের ওপর বিরূপ চাপ তৈরি করে চলেছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক রিজার্ভ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুচক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (মাসিক)’ তথ্য মতে, ২০২৫ সালের জুনে বাংলাদেশের মোট গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৭৭২ বিলিয়ন ইউএসডি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে , ২০২৫ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ইউএসডি। তবে ওগঋ পদ্ধতিতে (ইচগ৬ অনুযায়ী) রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ইউএসডি ধরা হয়েছে। এই রিজার্ভ রক্ষায় মুদ্রা-ছাড় এবং বৈদেশিক ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, কারণ রিজার্ভ কমে গেলে বিদেশি ঋণ, মুদ্রার ঘাটতি ও আমদানি বিল জটিলতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশ কম প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে বাজেটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৯০ ট্রিলিয়ন টাকা। এই বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। যার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের আয় এবং ব্যয় দুটোর মধ্যকার ভারসাম্য, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়ার সীমা ইত্যাদি অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করব।
২. ব্যাংক খাত: একীভূতকরণ, সূচক এবং চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংকিং খাত নানাবিধ সংস্কারের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, যার নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকিং খাতকে পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন করা হচ্ছে নানাভাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪-এ প্রকাশিত তথ্য ব্যাংক খাতের সার্বিক স্থিতিশীলতা নিয়ে বেশ উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের মূলধন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ অনুপাত (ঈজঅজ) নেমে এসেছে মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে, যেখানে সাধারণত নিরাপদ স্তর ধরা হয় ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এই অস্বাভাবিক পতন থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কঠিন সংকটে রয়েছে। একই সময়ে রিটার্ন-অন-এসেট ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে (-৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ)। তারমানে, অনেক ব্যাংক বর্তমানে লোকসানের মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। অপরদিকে অ্যাডভান্সড ডিপোজিট রেশিও (অউজ) বেড়ে হয়েছে ৮১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা ব্যাংকগুলোর সুদোপযোগী ঋণ বিতরণ সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক ব্যাংককে প্রভিশন বা পূর্বনির্ধারিত ক্ষতিপূরণের হার বাড়াতে হচ্ছে, ফলে তাদের মুনাফা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন- ব্যাংক একীভূতকরণের নীতিমালায় বলা হয়েছে, একীভূত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না এবং প্রথম তিন বছরের মধ্যে কর্মী ছাঁটাই করা যাবে না। সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্বের ঝগঅজঞ পদ্ধতির পরিবর্তে এখন গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি-ভিত্তিক হার চালু করা হয়েছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে ওঋজঝ ৯ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋরহধহপরধষ জবঢ়ড়ৎঃরহম ঝঃধহফধৎফ ৯) অনুযায়ী প্রত্যাশিত ঋণ ক্ষতি (ঊঈখ) ভিত্তিক প্রভিশনিং কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ঝুঁকি হিসাব ও ক্ষতি মোকাবিলার সক্ষমতাকে নতুন কাঠামো দেবে।
দুর্নীতি ও অর্থলোপাট রোধে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘বিগ ফোর’ অডিট ফার্ম নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং প্রায় ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ হারানো অর্থ উদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পেমেন্ট ও ক্লিয়ারিং ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের জন্য পেমেন্ট ও সেটেলমেন্ট সিস্টেম আইন, ২০২৪ পাস হয়েছে। একই সঙ্গে, ব্যাংকের বোর্ড ও প্রশাসনে যোগ্য, স্বচ্ছ ও সুনির্বাচিত নিয়োগ নিশ্চিত করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
তবে এসব উদ্যোগকে ঘিরে নতুন ধরনের উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক একীভূতকরণ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সাধারণ গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে- ‘ব্যাংকে অর্থ রাখা আদৌ নিরাপদ হবে কি না?’। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী শ্রেণি যারা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়েছেন, তারা নতুন নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। অপরদিকে মূলধন পর্যাপ্ততার হার কমে যাওয়া এবং প্রভিশনিং চার্জ বৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারছে না, যা পুঁজিবাজারেও অস্থিরতা তৈরি করছে। এর পাশাপাশি ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অনেক খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন বা পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব হচ্ছে না।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক সংকটাপন্ন কাল অতিক্রম করছে। গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম ভবিষ্যতে এই খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারে, তবে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীর আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে খাতটিকে টেকসই ও শক্তিশালী করতে হলে শুধু নীতিগত উদ্যোগ নয়, বরং বাস্তবায়নে কঠোরতা, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৩. ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ঘইঋও) ও মাইক্রোফাইনান্স খাত
বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ঘইঋও) ও মাইক্রোফাইনান্স খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ৭২৪টি মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত রয়েছে, যেগুলো মূলত ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ অর্থজগতে সেবা দিয়ে থাকে। তবে গত এক বছরে এ খাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তরলতা সংকট, ঋণা সমস্যা এবং গ্রাহক হারানোর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ঋণ চাহিদা বেড়ে গেলেও অর্থপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা খাতটিকে সংকটে ফেলছে। ফলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গ্রাহকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
সরকার কিছু ঘইঋও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেও যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি রয়ে গেছে। পুনর্বিন্যাস ও সীমিত নীতি দিয়ে এ খাতকে স্থিতিশীল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে তুলনামূলক শক্তিশালী ঘইঋও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন পণ্য, ডিজিটাল ফাইনান্স এবং মাইক্রোওয়েব সেবা চালু করার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাতটির পুনর্জাগরণে সহায়তা করতে পারে।
৪. বিমা খাত: সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিমা খাতের ভূমিকা হওয়া উচিত একটি মৌলিক স্তম্ভের মতো, বিশেষ করে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও এ খাত এখনও উল্লেখযোগ্য উন্নতির মুখ দেখেনি। বর্তমানে দেশে মোট ৮১টি বিমা কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে ৩৫টি জীবন বিমা এবং ৪৬টি সাধারণ বা নন-লাইফ বিমা। তবুও বিমা খাতের ঢ়বহবঃৎধঃরড়হ ৎধঃব বা অর্থনীতিতে বিমার অংশগ্রহণ মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে ভারতের হার প্রায় ৪ দশমিক ২ শতাংশ কিম্বা ভিয়েতনামের প্রায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয়, বাংলাদেশে বিমা ব্যবহার ও গ্রহণযোগ্যতা এখনও খুবই সীমিত। দাবি নিষ্পত্তি, প্রিমিয়াম নির্ধারণ, গ্রাহক আস্থা এবং প্রশাসনিক কাঠামো সব ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো স্পষ্ট।
বিমা খাতের পিছিয়ে পড়ার পেছনে বড় কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝুঁকি নির্ধারণে দুর্বলতা, দাবি প্রক্রিয়ার জটিলতা, প্রিমিয়াম নির্ধারণের সীমাবদ্ধতা এবং গ্রাহকের দীর্ঘদিনের আস্থাহীনতা। যদিও নতুন নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য বিমা ও কৃষি বিমা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের ধীরগতি এ খাতকে এগোতে দিচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল বিমা (ওহংঁৎঃবপয) এবং ব্যাংক ভিত্তিক বিমা (ইধহপধংংঁৎধহপব) মডেল দ্রুত চালু করা গেলে খাতটির পুনর্জাগরণ সম্ভব হবে, যা অর্থনীতিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সুরক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
৫. শেয়ারবাজার, বিনিয়োগ প্রবণতা ও মুদ্রাস্ফীতি-শেয়ারবাজার সম্পর্ক
একটি দেশের আর্থিক খাতের গতিধারা বোঝার অন্যতম নির্দেশক হলো শেয়ারবাজার। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (উঝঊ) প্রধান সূচক উঝঊঢ এ ধারাবাহিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। এই সূচক ইতোমধ্যে ৫ হাজার ৪০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছে, যা নিকট অতীতে প্রথমবারের মতো বাজারে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
তবে শেয়ারবাজারের উত্থান টেকসই করতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ও শেয়ারবাজারের পারফরম্যান্সের মধ্যে একটি ঋণাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে শেয়ারবাজার থেকে ইতিবাচক রিটার্ন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়, কাঁচামালের দাম ও শ্রম খরচ বাড়িয়ে দেয়, ফলে লাভের মার্জিন সংকুচিত হয় এবং শেয়ারের দামে প্রভাব পড়ে। তাই শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হতে হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
৬. আস্থা, প্রতিক্রিয়া ও জনমত
রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রচেষ্টা যেমন দৃশ্যমান, তেমনি জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয়ও স্পষ্ট। অনেক গ্রাহক ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত, বিশেষ করে যখন কোনো ব্যাংক একীভূতকরণ বা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার মুখে পড়ছে। বিনিয়োগকারীরাও সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় শেয়ারবাজার বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, নতুন ডিজিটাল ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের (গঋঝ) প্রসার কিছুটা আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে। সামগ্রিকভাবে, গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষ প্রতিবেদন, একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এবং স্বচ্ছ অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন।
৭. সুপারিশ ও অগ্রাধিকার
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের পরিবর্তনকে সফল করতে কয়েকটি দিকনির্দেশনা জরুরি। প্রথমত, আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ ও নিয়মিত যোগাযোগ প্রয়োজন। পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ও খেলাপি ঋণ নীতিমালা জনসমক্ষে স্পষ্ট করা এবং দুর্নীতি মামলায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল বা পুঁজি বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, শেয়ার ও বন্ড প্রকাশের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ তহবিল আহরণ করা। খেলাপি ঋণ দ্রুত পুনর্বিন্যাস ও ওঋজঝ ৯ ভিত্তিক প্রভিশনিং কার্যকর করাও অপরিহার্য। তৃতীয়ত, বিমা খাতে ডিজিটাল বিমা, মাইক্রোবিমা ও ব্যাংকাসিউরেন্স মডেল দ্রুত চালু এবং ঝুঁকি-ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। চতুর্থত, নিয়ন্ত্রক সক্ষমতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ডেটা বিশ্লেষণ, অগ্রিম সতর্কতা ব্যবস্থা ও নিয়মিত স্ট্রেস টেস্ট চালু করতে হবে। পেমেন্ট ও ক্লিয়ারিং সিস্টেমকে দ্রুত ও নিরাপদ করতে অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। সবশেষে, বাজেট নীতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়ন ও উৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করা এবং ওগঋ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্ব দেয়া।
পরিশেষে বলা যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। মাত্র এক বছরের মধ্যেই ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কারের প্রভাব স্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, মূলধন হ্রাস, দুর্বল শেয়ারবাজার, বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভ সংকট অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বড় বাধা। মনে রাখতে হবে, সাম্প্র্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি সূচনা মাত্র- অর্থনৈতিক সংস্কার হলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। স্বচ্ছ যোগাযোগ, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারে। আর সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করার গুরুদায়িত্বটি মূলত আগামী নির্বাচিত সরকারের ওপর।
সহযোগী অধ্যাপক (অ্যাডজ্যাংকট) আইইউবিএটি- ঢাকা
সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া
shahabuddin@um.edu.my
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post