শেখ শাফায়াত হোসেন : চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের হামলায় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের (এইচআর) হেডসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে ব্যাংকটির কার্যালয়ের সামনে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলায় আহত সিকিউরিটি গার্ড শাহিনুরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আমির হোসেনকে ভর্তি করা হয়েছে স্কয়ার হাসপাতালে। হামলার শিকার হন ব্যাংকটির তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। তবে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনার আগেই তাদের উদ্ধার করে পুলিশ সদস্যরা।
জানা গেছে, টানা আট কার্যদিবস আন্দোলনকারীরা ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় অবর”দ্ধ করে রেখেছে। এ ব্যাপারে পল্টন থানায় মামলা দায়ের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আল-আরাফাহ্ টাওয়ারে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে ব্যাংকের গুর”ত্বপূর্ণ কিছু কাজ করার জন্য পার্শ্ববর্তী সুরমা টাওয়ারে বসার ব্যবস্থা করা হয়। বিকাল ৪টায় ব্যাংকের তিনজন ডিএমডি ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আমির হোসেনসহ কয়েকজন সুরমা টাওয়ার থেকে নেমে গাড়িতে উঠছিলেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা ছুটে এসে তাদের গাড়ি ঘিরে ধরেন এবং আমির হোসেনকে বেধড়ক মারধর করেন। তাদের উদ্ধার করতে ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীরা ছুটে এলে তাতেও দমে না আন্দোলনকারীরা। এ সময় ঘটনাস্থল রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বলে জানা যায়।
ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের হাতে এসেছে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকের তিন ডিএমডি একটি গাড়িতে উঠতে গেলে তাতে বাধা দেয় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী। এক পর্যায়ে ব্যাংকটির নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। নিরাপত্তা কর্মীদের আন্দোলনকারীদের লাটিপেটা করতে দেখা যায়। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল ও ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেনÑআমির হোসেন, সিকিউরিটি গার্ড শাহিনুর, লিটন (২৫), ইলিয়াস (৩৮), ফাহিম (১৯), রকি হোসেন (২৬), তোফায়েল (৩২), নুর আলম (৪২), আরিফ (২৫), জাকির হোসেন (২৫), সাগর (২৯), লুৎফর, ফার”ক ও সোহেল।
ব্যাংকটি এস আলম গ্র”পের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। নিয়োগ বাণিজ্য, নিয়ম না মেনে নিয়োগ এবং চাহিদার তুলনায় বেশি নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটে অনেক। এমনকি ৬ শতাধিক কর্মকর্তার নিয়োগ দেয়া হয় সরাসরি তৎকালীন চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে। যার অনুমোদন নেয়া হয়নি ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকেও।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদারক সংস্থার তদন্তে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসংগতি সামনে আসে। বিষয়টি নিয়মের মধ্যে আনার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত ১ হাজার ৪১৪ কর্মকর্তার মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া হয়। এর মধ্যে অকৃতকার্য ৫৪৭ জনকে অব্যাহতি দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এই চাকরিচ্যুত কর্মীরা গত ২৮ জুলাই সকালে আকস্মিক আল-আরাফাহ্ ইসলামী বাংকের প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশমুখে জড়ো হয়ে মানবঢাল তৈরি করে। এরপর থেকে গত ৮ দিন ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা একইভাবে প্রধান গেট বন্ধ করে রাখে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন কিছু নতুন নতুন মুখ আসছে আল-আরাফাহ্ টাওয়ারের সামনে। এখনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর কোনো নির্দেশনা আসেনি বলে আন্দোলনকারীদের সরাতে পুলিশ কোনো শক্তি প্রয়োগ করেনি। তবে তাদের অবস্থান ও গতিবিধির ওপর তীক্ষè নজরদারি করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী এক ব্যাংক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, চাকরিচ্যুতরা আমাদের কাউকে অফিস করতে দিচ্ছে না। তারা বল প্রয়োগ করে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। তারা কর্মক্ষেত্রকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
মতিঝিল জোনের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগেও আরও চারটি ব্যাংকের কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। কিন্তু চাকরিচ্যুতরা এভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হয়েছে। তবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী বাংকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মানবিকভাবে সামলানোর চেষ্টা করছেন। যাতে বাস্তবতা বুঝতে পেরে বিক্ষুব্ধরা ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে এখন পেছন থেকে কিছু গ্র”প কাজ করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
এদিকে চাকরিচ্যুতদের দাবি, তাদের কোনো নোটিশ না দিয়ে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। চাকরি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের এক কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কর্মীদের মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম বিতর্ক তোলার সুযোগ নেই। তাছাড়া চাকরিচ্যুতরা এতদিন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। বৃহস্পতিবার হঠাৎ তারা মারমুখী হয়ে ওঠে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষ দিকে কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোয় মেধাবীরা চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া অনেক কর্মীকে যোগ্যতার থেকেও বড় পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এখন এই চাকরিচ্যুতদের মানবিক দিক সামনে এনে গোটা ব্যাংক খাতকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা চলছে।

Discussion about this post