নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : প্রথমে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিলেও সংখ্যা কমিয়ে তিনটিতে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক তিনটি হলোÑফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। তবে এই উদ্যোগ ঘিরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রায় ১৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা ও চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
অন্যদিকে, ব্যাংক একীভূতকরণ থেকে শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও এক্সিম ব্যাংক। কারণ তারা একীভূতকরণে রাজি হয়নি। বরং ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ব্যাংক দুটির পরিচালনা পর্ষদ।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচিত ব্যাংকগুলোর মূল মালিকানা একটি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুরবস্থা চলমান থাকায়, মার্জারই ছিল স্বাভাবিক সমাধান। তবে সমস্যা হচ্ছে, একীভূত ব্যাংকের কার্যক্রম গুছিয়ে আনতে গেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকায় অনেককেই ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হতে পারেন। সেই আতঙ্ক কাজ করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
জানা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৯৯৬ জন। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন, আর ইউনিয়ন ব্যাংকে আছেন প্রায় ৫ হাজার ৮০৭ জন। সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকের জনবল প্রায় ১৪ হাজার। একীভূত ব্যাংকে এই বিপুল জনবল রক্ষা করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা প্রথম থেকেই সংশয় প্রকাশ করে আসছেন।
এ ব্যাংকগুলোর সিংহভাগ শেয়ার চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন। কিন্তু ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। পাশাপাশি বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এর কারণে কর্মকর্তাদের চাকরি হারানোর আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোয় কর্মীদের বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অনেকেই বেতন না পেয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। একীভূতকরণ পরবর্তী সময়ে যদি ঢেলে সাজানো হয় কাঠামো, তবে চাকরি হারানোর শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
চাকরি হারানোর প্রসঙ্গে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি উপজেলায় নতুন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখা খোলা হবে। একইসঙ্গে এটি সরকারি মালিকানাধীন হবে। সোনালী ব্যাংকের পর এই ব্যাংকের নেটওয়ার্ক হবে বেশি।
গত কয়েক বছর ধরেই এ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমানতকারীদের আস্থা হারিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে আমানত প্রত্যাহারের হার বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার রেগুলেটরি সহায়তা দেয়ার পরও ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৪ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক অডিট প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার বিশাল লোকসান দিলেও, ব্যাংকটির ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্রে কারসাজির মাধ্যমে দেখিয়েছে ১২৮ কোটি টাকার মুনাফা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মীদের চাকরি যাবে না বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলেও কর্মীদের মধ্যে থেকে এই ভয় যাচ্ছে না। কারণ এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলের কর্মীদের তুলনায় টপ লেভেলের কর্মকর্তাদের সবাইকে হয়তো একীভূত হওয়া একটি ব্যাংকে প্রয়োজন হবে না। যেমন ধরেনÑএমডি, ডিএমডি বা এর অব্যবহিত নিচের পদগুলোয় যারা কাজ করে তাদের অনেককেই চাকরি হারাতে হবে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকটি স্বাভাবিক নিয়মে চললে আমি হয়তো অন্তত একটি প্রমোশন পেতাম এতদিন। দুটি প্রমোশনের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু পাইনি। এখন একীভূতকরণের মধ্যে ঢুকলে এই প্রমোশন কীভাবে পাব তার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক দিত তাহলে হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারতাম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একীভূতকরণ একটি কাঠামোগত সমাধান হতে পারে বটে, তবে যথাযথ গভর্ন্যান্স ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা ছাড়া এটি টেকসই হবে না। একীভূত ব্যাংক যদি আগের দুর্বল ব্যবস্থাপনা বহাল রাখে, তাহলে নতুন রূপেও পুরোনো সংকট বহাল থাকবে। কর্মী ছাঁটাই নয়, বরং দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় কর্মীদের রক্ষার জন্য জনবল পুনর্বিন্যাশের পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। একীভূত ব্যাংকগুলো প্রথমে সরকারি ব্যাংকের মতো করে চলবে। ওই সময়টাতে কর্মীদের চাকরি হারানোর ভয় নেই। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে এমন কোনো নিশ্চয়তা এখনও তারা পাননি। বরং শাখা পর্যায়ে ছাঁটাইয়ের গুঞ্জন, বেতন বিলম্ব ও কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়ছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমীন শেয়ার বিজকে বলেন, এই ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ আর্থিক সূচক খারাপ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে একটি ফরেনসিক অডিট করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই মূল্যায়নে যদি ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থা আসে তাহলে একীভূত হতে হবে না। আবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে তো একীভূত না হয়েও কোনো উপায় থাকবে না।
‘আমরা তো চাই স্বতন্ত্রভাবে ব্যাংক চালাতে। কিন্তু সেটাও তো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছে,’ যোগ করেন তিনি। তবে সবগুলো ব্যাংক যেহেতু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, এগুলো একীভূত করতে পারলে একটি বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন নুরুল আমীন।

Discussion about this post