শাহিন আলম : বিশ্ববাজারে যখন পোশাক খাত বিকশিত হচ্ছিল, তখন সমান্তরালভাবে চামড়া শিল্পও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু গত এক দশকে আমরা চামড়া শিল্পকে সম্ভাবনা থেকে সংকটে পরিণত হতে দেখেছি। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত অসঙ্গতি, আন্তর্জাতিক মানের অভাব এবং সরকার ও উদ্যোক্তাদের যৌথ ব্যর্থতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত আজ ধ্বংসপ্রায়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম যখন এ খাতকে নতুন রপ্তানি হাবে রূপান্তর করেছে, তখন আমরা বারবার ব্যর্থ নীতির চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি।
ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে ট্যানারি জোন স্থাপিত হলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এসে এটি একটি রপ্তানি-নির্ভর খাতে রূপ নেয়, যেখানে ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান ছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ১২৫৮.৮২ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল জাতীয় রপ্তানির প্রায় ৪ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছিল ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। অর্থ্যাৎ ক্রমহ্রাসমান।
পরিবেশগত ঝুঁকি কমাতে এবং আধুনিকীকরণে সহায়ক হতে ২০০৩ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে ট্যানারি শিল্পকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্দেশ্যে সাভারে ২০০ একর জমিতে চামড়া শিল্প নগরী নির্মাণ এবং একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট (CETP) স্থাপন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই স্থানান্তর ছিল এক চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। চীনা ঠিকাদার ফারচেন কোম্পানি সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, সিএটিপি আজও পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করে না। ফলত সাভার এলাকাও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকিতে পড়ে। তদুপরি, প্লট বরাদ্দ ও জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতায় উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পেতে ব্যর্থ হন, ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
বর্তমানে বিশ্বের চামড়াজাত পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে চীন, ইতালি, ভারত, ব্রাজিল ও তুরস্ক মিলিয়ে ৬০ শতাংশেরও বেশি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএম আই কনসালটিং সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে চামড়াজাত পণ্য অর্থাৎ জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ ইত্যাদির বাজারের আকার ছিল ২১ হাজার ৭৪৯ কোটি ডলারের। পরের বছর সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ২৭০ কোটি ডলারে। আবার ২০৩৩ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫ হাজার ২৯০ ডলারে। বৈশিক বাজার বড় হলেও বাংলাদেশের রপ্তানি তেমন বাড়েনি। ভিয়েতনাম ২০২৩ সালে ২২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। একই বছরে ভারতের রপ্তানি ছিল ১২ লাখ ডলার। তার মানে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ১৯ গুণ এবং ভারত ৪ গুণ বেশি চামড়া রপ্তানি করেছে। এর অন্যতম কারণ হল আন্তর্জাতিক মানের অনুপস্থিতি। বাংলাদেশ এখনো LWG (Leather Working Group), ISO, বা ESG-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড অর্জনে ব্যর্থ। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশ বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্য বর্জন করেছে পরিবেশগত সনদ না থাকার কারণে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চামড়া খাতের ১ হাজার ২০৬টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এই সনদ পাওয়া বেশি কোম্পানি রয়েছে ইতালিতে ২৫৪টি, ভারতে ২৫১টি এবং চীনে ২০৬টি সনদ পাওয়া কারখানা আছে। অপরদিকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়া কারখানা রয়েছে মাত্র ৭টি। এই ব্যর্থতা শুধু আন্তর্জাতিক রপ্তানির সুযোগ হারানো নয়, বরং দেশের ব্র্যান্ড ইমেজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর কোরবানির ঈদে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ পশু জবাই হয়, যার চামড়ার বাজারমূল্য আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই বিশাল অর্থনৈতিক সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় লবণের সংকট, সিন্ডিকেট কর্তৃক দামের কৃত্রিম পতন, কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার অভাব এবং বাজারে প্রতিযোগিতাহীন অবস্থান— সব মিলিয়ে চামড়া পঁচে যাওয়া ও মাটিতে পুঁতে ফেলা এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। ২০১৯ সালে অন্তত ২ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়েছিল, যা অর্থনীতিতে এক অঘোষিত বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক চাকরি হারায় চামড়া শিল্পে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাস, সাভারে স্থানান্তর-জনিত খরচ, ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একসঙ্গে এ খাতকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই ব্যাংক খেলাপি হয়ে পড়েন এবং পুনর্বিনিয়োগের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বিশ্বব্যাংক ও ADB বারবার সরকারকে নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও পরিবেশ-সমর্থন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ খুব কমই নেয়া হয়েছে।
এই খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো একে অপরকে দোষ চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি। BISIC, পরিবেশ অধিদপ্তর, RAJUK, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়— কেউই কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলতে পারেনি। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সরকারি সংস্থাগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাগ্রহী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্যদিকে সরকারের দাবি, অনেক উদ্যোক্তা বরাদ্দকৃত ঋণ ব্যক্তিগত খাতে অপব্যবহার করেছেন। ফলে দায়-দায়িত্বহীনতার মাঝে প্রকৃত সমাধান অনুপস্থিত রয়ে গেছে।
২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা হারাতে পারে, যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্প বিপদে ফেলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে চামড়া শিল্প বিকল্প রপ্তানি আয়ের খাতে রূপ নিতে পারে, যদি এখন থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া যায়। ভারতের মতো দেশ এরই মধ্যে চামড়া নগরী, বিদেশি ব্র্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও ব্র্যান্ডিংয়ে বিপুল বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের উচিত ইউরোপীয় সহায়তায় CETP পূর্ণ বাস্তবায়ন, LWG সার্টিফিকেশন অর্জন, SME উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, এবং ‘Made in Bangladesh’ ব্র্যান্ড হিসেবে চামড়াকে নতুন করে উপস্থাপন করা।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প শুধু একটি রপ্তানি খাত নয় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা, উদ্যোক্তাদের পুঁজি এবং একটি সম্ভাবনাময় জাতীয় সম্পদ। কিন্তু এ শিল্প বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় জর্জরিত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। সময় এসেছে এই খাতকে মৌসুমি বাণিজ্যের বাইরে এনে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সনদ অর্জন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা— সবকিছু একসঙ্গে বাস্তবায়ন হলেই বাংলাদেশ আবারও চামড়াকে একটি গর্বিত রপ্তানি খাতে পরিণত করতে পারবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Discussion about this post