শেয়ার বিজ ডেস্ক : পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহর থেকে তিন ঘণ্টা উত্তরে এনিয়াব্বা এলাকাÑশুষ্ক ও জনশূন্য বিস্তীর্ণ ভূমি। এখানকার একটি বিশাল গর্তে মজুত রয়েছে এক মিলিয়ন টনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ বা রেয়ার আর্থ। এগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি, উইন্ড টারবাইন ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে অপরিহার্য।
অস্ট্রেলিয়া এই খনিজ আহরণের জন্য একটি খনন কোম্পানিকে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ দিচ্ছে, যাতে চীনের একচেটিয়া সরবরাহ চেইনে ধাক্কা দেয়া যায়। খবর বিবিসির।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ইউরোপে ‘রেয়ার আর্থ’ শিল্প ছিল সক্রিয়, কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব খনিজ চীন থেকে আসে। চীন বিশ্বে অর্ধেকের বেশি রেয়ার আর্থ খনন ও প্রায় ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় রেয়ার আর্থের ৮০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৯৮ শতাংশ চীন থেকে আমদানি হয়।
কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাক একস্টিন বলেন, ‘পশ্চিমারা এই খাতে পিছিয়ে পড়েছে, চীন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।’
ইলুকা রিসোর্সেস নামের অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি কয়েক দশক ধরে সিরামিকস ও পেইন্ট তৈরির জন্য জিরকন উত্তোলন করছিল। খনিজ বালুর উপজাত হিসেবে তাদের হাতে জমেছে ডাইস্প্রোসিয়াম ও টার্বিয়ামÑসবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন রেয়ার আর্থ উপাদান। এ স্টকপাইলের বাজারমূল্য এখন ৬৫০ মিলিয়ন ডলার।
তবে খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রেয়ার আর্থের উপাদানগুলো রাসায়নিকভাবে এতটাই কাছাকাছি যে আলাদা করতে বহু ধাপের প্রক্রিয়া লাগে, আর তাতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়ান সরকার ইলুকাকে ১.৬৫ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার ঋণ দিচ্ছে একটি রিফাইনারি স্থাপনের জন্য, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করছে কোম্পানিটি।
অস্ট্রেলিয়ার রিসোর্সেস মন্ত্রী ম্যাডেলিন কিং বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও রেয়ার আর্থের জন্য উš§ুক্ত আন্তর্জাতিক বাজার বাস্তবে নেই। একটি দেশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, আমরা এর বিকল্প সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তুলতে চাই।’
গাড়ি নির্মাতা ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য রেয়ার আর্থ অপরিহার্য হওয়ায় দেশগুলো এখন চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। ইলুকা জানিয়েছে, তাদের রিফাইনারি চালু হওয়ার আগেই অনেক কোম্পানি অর্ডার দিচ্ছে।
রেয়ার আর্থ খনন নয়, বরং প্রক্রিয়াজাতকরণই পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকরÑযা তেজস্ক্রিয় ও বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি করে। চীনে বছরের পর বছর নিয়ন্ত্রণহীন প্রক্রিয়াকরণে পানি ও মাটির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া বলছে, তাদের আইনি ও পরিবেশগত কাঠামো এই ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অতীতে চীনের ওপর ‘প্রায় একচেটিয়া’ বাজার দখলের অভিযোগ তুলেছে। যদিও এখন কিছুটা সরবরাহ উš§ুক্ত হয়েছে, তবুও সরবরাহ চেইনের ধাক্কা লাগার ঝুঁকি রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া এখন চেষ্টা করছে একটি টেকসই, পরিচ্ছন্ন ও স্বাধীন রেয়ার আর্থ শিল্প গড়ে তুলতেÑযেটি চীনের বিকল্প হতে পারে।
ড্যান ম্যাকগ্রাথ, ইলুকা রিসোর্সেসের রেয়ার আর্থ বিভাগের প্রধান বলেন, চীন খুব সচেতনভাবে এবং খোলাখুলিভাবে বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, যাতে তাদের নিজস্ব উৎপাদন ও প্রতিরক্ষা শিল্পে সহায়তা হয়। যখন তিনি আমাদের কোম্পানির বিশাল এনিয়াব্বা সাইটে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন।
তবে ম্যাকগ্রাথ ও ইলুকা আশা করছেন, তারা সেই নিয়ন্ত্রণে আঘাত হানতে পারবেন যদিও এটি কোম্পানির মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল না। দশকের পর দশক ধরে ইলুকা অস্ট্রেলিয়ায় জিরকন খনন করে আসছে; যা সিরামিকসে ব্যবহƒত একটি মূল উপাদান, আর টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড ব্যবহƒত হয় রং, প্লাস্টিক ও কাগজে।
হঠাৎ দেখা যায়, এই খনিজ বালির উপজাত হিসেবে ডাইস্প্রোসিয়াম ও টার্বিয়াম পাওয়া যায়। যেগুলো সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন রেয়ার আর্থ উপাদান। বছরের পর বছর ধরে ইলুকা এই উপাদানের মজুত গড়ে তুলেছে, যা এখন ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের। তবে এটি ছিল সহজ অংশ। আসল চ্যালেঞ্জ হলো এই খনিজের প্রক্রিয়াকরণ বা পরিশোধন।
এই উপাদানগুলো রাসায়নিকভাবে খুব কাছাকাছি, তাই একে অপর থেকে আলাদা করতে অনেক স্তরের প্রক্রিয়া লাগে, ব্যাখ্যা করেন অধ্যাপক একস্টিন। এছাড়া এই শিল্প থেকে বর্জ্য ও অবশিষ্ট পদার্থ তৈরি হয়, যা বড় সমস্যা। এতে প্রায়ই তেজস্ক্রিয় পদার্থ তৈরি হয়। এর জন্য বড় মূল্য দিতে হয় এবং এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ার সরকার ইলুকাকে ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ দিচ্ছে একটি পরিশোধনাগার গড়ার জন্য। কারণ ইলুকা আশা করছে এই দশকের শেষে রেয়ার আর্থসের চাহিদা ৫০ শতাংশ থেকে ১৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
ম্যাকগ্রাথ বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে পশ্চিমা দেশের রেয়ার আর্থসের উল্লেখযোগ্য অংশ আমরা সরবরাহ করতে পারব। আমাদের গ্রাহকরা বুঝেছেন যে চীনের বাইরে স্বাধীন, নিরাপদ ও টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য অপরিহার্য।
ম্যাকগ্রাথ বলেন, এই পরিশোধনাগার ও ইলুকার রেয়ার আর্থস ব্যবসার প্রতি প্রতিশ্রুতি চীনের বিকল্প হতে পারে। তবে এ পরিশোধনাগারটি নির্মাণ ও চালু হতে আরও দুই বছর সময় লাগবে। ‘অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে আমাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব না থাকলে, একটি রেয়ার আর্থস প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব হতো না।’