শেয়ার বিজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি জেনারেল মোটরস (জিএম) চীন থেকে সরবরাহ ব্যবস্থা সরিয়ে নিতে চায়। এ লক্ষ্যে হাজারখানেক সরবরাহকারীকে তারা নির্দেশনা দিয়েছে, যন্ত্রাংশের যে সরবরাহ তারা এত দিন চীন থেকে দিত, তা সরিয়ে নিতে হবে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত চারজন এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মূলত ভূরাজনৈতিক কারণেই জিএম এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর-রয়টার্স।
জিএমের নির্বাহীরা সরবরাহকারীদের বলছেন, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের সরবরাহ চীন থেকে সরিয়ে নিতে হবে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, এই সরবরাহ ব্যবস্থা চীন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেয়া। এমনকি কিছু কিছু সরবরাহকারীকে তারা এমন নির্দেশনাও দিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে চীন থেকে সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি সরিয়ে নিতে হবে।
এই প্রক্রিয়া আজ থেকে নয়, ২০২৪ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। জিএম বলেছে, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করা চলবে না। চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন-চীন বাণিজ্যবিরোধ আগের তুলনায় বেড়ে গেলে জিএম এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করে।
জিএমের নির্বাহীরা বলছেন, সরবরাহব্যবস্থা আরও গতিশীল করতে চান তারা। সে লক্ষ্যেই এই নির্দেশনা। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক উত্তেজনার পাশাপাশি বিরল খনিজ ও চিপ বাণিজ্যে উভয় দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে কোম্পানিটি সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হচ্ছে। আরও অনেক খাতের মতো চীন জিএমের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ উৎস।
নিজ দেশে গাড়িসহ সবকিছু উৎপাদনে জোর দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এই শিল্প খাতের নির্বাহীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসছে। এই চাপে পড়ে কোম্পানিগুলোও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের দিকে যাচ্ছে, যদিও এতে অনেক সময় লেগে যাবে।
জিএমের বেশির ভাগ গাড়ি উত্তর আমেরিকাতেই তৈরি হয়। ফলে এসব গাড়িতে ব্যবহƒত কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের সরবরাহ চীন থেকে সরিয়ে নেয়া তাদের মূল লক্ষ্য। উত্তর আমেরিকায় তৈরি গাড়ির যন্ত্রাংশের জন্য তারা উত্তর আমেরিকার কারখানার ওপরই নির্ভর করতে চাচ্ছে, এটা যেমন ঠিক; তেমনি চীনের বাইরে অন্যান্য দেশ থেকে এই সরবরাহ পাওয়া যায় কি না, সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে।
শুধু চীন নয়, আরও যেসব দেশ ভূরাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে, যেমন রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা-জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এসব দেশ থেকেও যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল নেবে না জিএম। যদিও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল আরও বেশি।
ব্যাটারি ও চিপের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে জিএম। যুক্তরাষ্ট্রের বিরল খনিজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তারা অংশীদারিতে গেছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির উপকরণ তৈরিতে নেভাদার লিথিয়াম খনিতে বিনিয়োগ করেছে তারা। এখন তারা আরও প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উপাদান লাভের চেষ্টা করছে।
জিএমের প্রধান নির্বাহী ম্যারি ব্যারা সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতার কথা জোর দিয়েই বলেছেন। সম্ভব হলে যে দেশে গাড়ি উৎপাদিত হবে, সেই দেশ থেকে সরবরাহ নেয়ার পক্ষপাতি তিনি।
মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে এখন একধরনের বিরতি চলছে। উভয় পক্ষই বিপুল হারে শুল্ক আরোপের পর কিছু শুল্ক আবার প্রত্যাহার করেছে। অক্টোবরে দুই দেশের প্রেসিডেন্টের বৈঠকেও তেমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তাতে গাড়ি ব্যবসায়ীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। গাড়িশিল্পের বেলায় এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কেননা এই শিল্পের পণ্য পরিকবল্পনা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম জমানায় এই শুল্ক-যুদ্ধ শুরু হয়। গাড়ি কোম্পানিগুলো তখন থেকেই সরবরাহব্যবস্থা চীন থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এবার ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপরই যে শুল্ক চাপিয়েছেন, চীনও তার পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
বিষয়টি হলো, চীনের হাতে আছে বিরল খনিজের মতো অব্যর্থ অস্ত্র। গাড়ি থেকে শুরু করে সব ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরিতে এই বিরল খনিজ ব্যবহƒত হয়। ফলে গাড়ি কোম্পানিগুলো এসব উপাদান মজুত করেছে। এরপর অক্টোবরে চীন এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরও উপাদান যুক্ত করে। যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের পক্ষে সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা ব্যয়বহুল ও জটিল হতে পারে। গাড়িশিল্পের সরবরাহ ব্যবস্থার কিছু ক্ষেত্রে, যেমন আলোকসজ্জা, ইলেকট্রনিকসসহ বিশেষ যন্ত্রাংশ তৈরিতে চীন এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে তাদের বিকল্প উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরবরাহকারীরা এমনটাই মনে করছেন। সরবরাহকারীরা বলছেন, এটা মহিরুহ উদ্যোগ। সরবরাহকারীরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেহিকেল সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কলিন শ’ বলেন, গাড়ি কোম্পানি ও বড় সরবরাহকারীরা চীনসহ কিছু দেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলকে ‘ঝুঁকিমুক্ত’ করতে চাইছে। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরীণ পণ্য উপকরণ ও কাঁচামালের নেটওয়ার্ক এতটাই গভীর যে বিকল্প খোঁজার প্রচেষ্টা জটিল হয়ে পড়েছে।
কলিন আরও বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা ২০ থেকে ৩০ বছরের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছেÑ অথচ আমরা কয়েক বছরের মধ্যে তা বদলাতে চাইছি। এটা এত দ্রুত সম্ভব নয়।
