আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : রাজশাহী নগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় রাজশাহী ওয়াসার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের ১ আগস্ট। শুরু হয়েছিল ৫৬টি গভীর নলকূপ, একটি পানি শোধনাগার ও সিটি করপোরেশন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রায় ৭৭১ কিলোমিটার পুরোনো পাইপলাইন নিয়ে। কিন্তু এক যুগ পার হতে না হতেই ওয়াসার সামনে দেখা দিয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ পানি চুরি, সিস্টেম লস, জনবল সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ।
ফলে সংস্থাটি প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পানি চুরি ও কারিগরি অপচয়ের কারণে ৮ থেকে সাড়ে ৮ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়ছে। একইসঙ্গে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়লেও রাজস্ব আদায় তুলনামূলকভাবে কমছে, যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র নগরীর পানি ব্যবস্থাপনায়।
রাজশাহী ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, উত্তোলিত পানির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হারিয়ে যায় চুরি, পাইপলাইনের ফুটো, পুরোনো সংযোগ, অবৈধ লাইন এবং কারিগরি অপচয়ে।
ওয়াসার কর্মকর্তাদের ভাষায় এটি সিস্টেম লস, কিন্তু বাস্তবে এটি সংস্থার আর্থিক ক্ষতি, পানি ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ এবং গ্রাহকের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। দৈনিক আড়াই কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে শুধু সিস্টেম লসের কারণে। পানি চুরি হচ্ছে নির্মাণ সাইটে অবৈধ সংযোগ, পাইপ কেটে নেয়া লাইন, অনুমোদনহীন হোটেল রেস্টুরেন্ট, পুরোনো লাইনের ফাটল দিয়ে লিকেজ, কলোনি ও আবাসিক এলাকায় গোপনে পানি সংগ্রহ এসব মিলেই তৈরি হয়েছে ভয়াবহ অবস্থা।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ বলেন, সিস্টেম লস স্বাভাবিকভাবে ১০ শতাংশ সহনীয়। কিন্তু জনবল সংকট, পুরোনো পাইপলাইন এবং অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, অবৈধ সংযোগের কারণে রাজশাহীতে তা বেশি। প্রতিদিন বিপুল পানি অপচয় হচ্ছে, যা রাজস্ব ক্ষতির বড় কারণ।
ওয়াসা যখন কার্যক্রম শুরু করে, তখন নগরীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ। ১৪ বছর পর এখন এই সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। কিন্তু পানি উত্তোলন, শোধন ও বিতরণের পরিকল্পনা এখনো পুরোনো জনসংখ্যা হিসাবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকট, পাইপলাইনে পর্যাপ্ত চাপ না থাকা, বাড়তি চাহিদা পূরণে নলকূপ ও সাবমারসিবলের ওপর নির্ভরশীলতা দ্রুত বেড়েছে।
এগুলো রাজশাহী মহানগরীর জন্য বাস্তব চিত্র। তবে ওয়াসার বক্তব্য এখন আমরা সমস্যা উত্তরণে বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখছি।
রাজশাহী শহরে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার, কিন্তু ওয়াসার সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার। অর্থাৎ দৈনিক ২ কোটি ৬৭ লাখ লিটার ঘাটতি রয়ে গেছে, যা বাসাবাড়ির নলকূপ ও পুকুরের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে যেহেতু, ওয়াসা দৈনিক ভূ-গর্ভ থেকে ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করে, কিন্তু শোধনাগারের সক্ষমতা মাত্র ৯৬ লাখ লিটার। অপরিশোধিত পানি সরাসরি পাইপলাইনে সরবরাহ হওয়ায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি দূষণ, দুর্গন্ধ ও জীবাণু পাওয়া গেছে এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিকবার খবরও প্রকাশ হয়েছে।
এক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, অনেক সময় পানি ঘোলা থাকে। রান্না ও খাবারের আগে ফিল্টার করতে হয়। ওয়াসা স্বীকার করেছে, পুরোনো পাইপলাইন থেকেই বেশি দূষণ হয়ে থাকে। পাইপ লাইন পুরোনো, রক্ষণাবেক্ষণে জনবল নেই, ওয়াসার এই ৭৭১ কিলোমিটার পাইপলাইনের অধিকাংশই সিটি করপোরেশন আমলের পুরোনো লাইন। অন্যদিকে ওয়াসার জনবল সংখ্যা মাত্র আড়াই শতাধিক, কিন্তু প্রয়োজন প্রায় তিনগুণ। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না নিয়মিত।
প্রধান প্রকৌশলী আরও জানান, লাইন রক্ষণাবেক্ষণ, অবৈধ সংযোগ চিহ্নিতকরণ, অপচয় রোধ এসব ক্ষেত্রে জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। আমরা এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করছি।
রাজশাহী ওয়াসা বছরে পানি উত্তোলনে খরচ করে ১০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু পানির জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে রাজস্ব আসে মাত্র ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা থাকে ২৭ থেকে ৩০ কোটি, কিন্তু তা পূরণ হয় না।
প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ বলেন, প্রতি হাজার লিটার পানি উত্তোলনে খরচ হয় ৮ টাকা ৯০ পয়সা, কিন্তু আবাসিক গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হয় ৬ টাকা ৮১ পয়সায়। ফলে লোকসান হওয়া স্বাভাবিক। অন্যদিকে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি হাজার লিটারের দাম ১৩ টাকা ৬২ পয়সা, কিন্তু সেখানে চাহিদা ও সংগ্রহ কম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক জানান, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে। শোধনাগার বাড়ানো ও পদ্মার পানি ব্যবহারের পরিকল্পনা আরও আগে হওয়া উচিত ছিল।
রাজশাহীবাসীর দৃষ্টি এখন ওয়াসার ৪ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের দিকে। চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির লক্ষ্যÑ গোদাগাড়ীতে পদ্মার পানি তুলে শোধন করা, শোধিত পানি পাইপলাইনে পুরো রাজশাহী জুড়ে সরবরাহ, শতভাগ বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো। ওয়াসার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৭ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তখন আর পানি সংকট থাকবে না এবং সিস্টেম লসও কমে আসবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জাকির হোসেন বলেন, ওয়াসার সিস্টেম লস বর্তমানে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। তবে মেগা প্রকল্প শেষ হলে লস ১০ শতাংশের নিচে নামানো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, নতুন প্রকল্পে ওয়াসার রাজস্ব বাড়ার পাশাপাশি পানি সরবরাহে বিপ্লব ঘটবে। ভবিষ্যতে রাজশাহী একটি মডেল ওয়াসা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াসায় ৩০০ জন নতুন জনবল নিয়োগ, পুরোনো পাইপ বদলে নতুন গ্রিড লাইনে রূপান্তর, অবৈধ সংযোগ শনাক্তে বিশেষ টাস্কফোর্স, প্রতিটি ওয়ার্ডে লস ম্যানেজমেন্ট ইউনিট, পানি শোধনাগার বাড়ানো, আর্থিক নিয়মনীতি শক্ত করা হলে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
নগরবাসীর প্রত্যাশা ওয়াসার এই কথিত লোকসান, সিস্টেম লস এবং পানি চুরির ঘটনা আর যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post