শেখ শাফায়াত হোসেন : বড় ধরনের লুটপাট সত্ত্বেও অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু এর মধ্যেও একের পর এক সংকট লেগে রয়েছে ব্যাংকটিতে। গত মে মাসে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্ম মুনিরুল মাওলাকে অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে ব্যাংকটি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষরে চেয়ারম্যান মো. ওবায়ে উল্লাহ আল মাসুদ পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে ব্যাংকটির একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটির লুট হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে উল্টো বাধা হয়ে উঠেছিলেন চেয়ারম্যান নিজেই। এ কারণে গত মাস খানেকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিল। গত সোমবার মাসুদের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ওই দিন পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে থাকার জন্য বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দেখা করতে অনেক চেষ্টা করেন তিনি। তবে দেখা করতে পারেননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ’চেয়ারম্যান আজকে তার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না।’
গত সোমবার ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব তলব করে বিএফআইইউ। সম্প্র্রতি এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের সঙ্গে খো করতে যান ওবায়ে উল্লাহ মাসুদ। গভর্নর ভবনের প্রবেশ গেটের ওয়েটিং রুমে সাক্ষাতের আশায় দীর্ঘ সময় বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারও সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলেনি। পরে হতাশ মন নিয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে।
ব্যাংক হিসাব তলব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘স্বচ্ছতার স্বার্থে ব্যাংক চেয়ারম্যানরে হিসাব তলব করা হচ্ছে। এটি ধাপে ধাপে সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আমি এই পক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে দেখি।’
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বিগত সরকারের সময়ে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্শেনায় ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষ গঠনের সময় তাকে স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ য়ো হয়। ইসলামী ব্যাংকসহ এখন পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি ব্যাংকটিতে নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জোবায়দুর রহমানকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাকে চেয়ারম্যান করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আভাস পাওয়া গেলেও এতে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান কর্মীদের একটি অংশ সম্মত নন। এ কারণে গত ১১ জুলাই ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যানের সর্মক হিসেবে পরিচিত কিছু শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারী প্রধান কার্যালয়ের সামনে জোবায়দুর রহমানের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
এ পরিস্থিতিতে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুরে ব্যাংক হিসাব তলবকে কেন্দ্র করে ব্যাংক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিএফআইইউ যে চিঠি পাঠিয়েছে, সেখানে মাসুরে পাশাপাশি তার স্ত্রী মারজিনা বেগম ওরফে মুনমুন মাসু, দুই ছেলে জুন্নুন সাফওয়ান ও জুনায়েন জুলকার নায়েন তিয়ান এবং মেয়ে তাসমিয়া তারান্নুম নাওমির হিসাবও চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, তারে নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব, সঞ্চয়পত্র, বন্ড, লকার সার্ভিস, স্টুডেন্ট ফাইল, ক্রেডিট কার্ড, প্রিপেইড বা গিফট কার্ডের তথ্য জমা দিতে হবে। এছাড়া তারে স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো হিসাব চালু থাকলে তা-ও জানাতে বলা হয়েছে। ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা বা তূর্ধ্ব অঙ্কের লেনদেনের সব তথ্য বিএফআইইউতে জমা য়োর নির্শে দেয়া হয়েছে। এমনকি আগে পরিচালিত হলেও বর্তমানে বন্ধ থাকা হিসাবগুলোর তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং তার আগে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সোনালী ব্যাংক থেকে অবসরের পর দীর্ঘ বিরতি শেষে তিনি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে তার অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েন। এ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ভেতরে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে বলেও ব্যাংকসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি পক্ষ বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপকে বাঁচাতে কাজ করছে। তারে সমর্থন দিচ্ছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।
এ দিকে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করা ওমর ফারুক খানকে পূর্ণাঙ্গভাবে এমডির দায়িত্ব পালনের সুযোগ য়োর জন্য গত সোমবার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য আবেদন পাঠায়। সাধারণ এ ধরনের ব্যাংকের এমডির নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তির দরকার হয়। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ওমর ফারুক খানের এমডির নিয়োগের বিষয়ে অনাপত্তি প্রদান করেনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ’আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ নিয়ে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।’