শেখ শাফায়াত হোসেন : সম্প্রতি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এক হাজার ১৬ কোটি টাকা খরচ করে একটি বাণিজ্যিক ভবন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করছেন নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ধারণা, মাত্র ২৫০ কোটি টাকা থেকে ৩০০ কোটি টাকায় মতিঝিলের মতো প্রাইম লোকেশনেও এ ধরনের ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। অভিযোগ উঠেছে, কয়েকগুণ বেশি দামে ভবনটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে ভবন মালিক। এতে ব্যাংকের মুনাফা কমে আসবে। প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হবেন শেয়ারগ্রহীতা।
জানা গেছে, সাড়ে ২১ তলা এ ভবনটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সায়েম আহমেদের মা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী আছমা আহমেদের মালিকানাধীন। বর্তমান চেয়ারম্যান সাদিয়া রাইন আহমেদের (শাহাবুদ্দিন আহমেদের মেয়ে) সভাপতিত্বে গত ২৬ আগস্ট ব্যাংকের পর্ষদ এই ভবনটি কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তটি ব্যাংকের শেয়ারগ্রহীতাদের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার মতিঝিলে যে ভবনটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কিনতে রাজি হয়েছে, সেটির হোল্ডিং নম্বর ৪৭, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। গত পাঁচ বছর ধরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে এই ভবনটি উচ্চ ভাড়ায় ব্যবহার করে আসছে। মোট ২ লাখ ৭ হাজার ৩৪০ বর্গফুট আয়তনের এ ভবনের প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা।
নির্মাণখাত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে সর্বোচ্চ ৪০০০-৪২০০ টাকা খরচ হতে পারে। সেই হিসাবে ভবনটির বাজার মূল্য অনেক কমে আসবে। তাছাড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে আরও পাঁচ বছর আগে। সেই হিসাবে দাম আরও কম হওয়ার কথা।
গত ২৭ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমিসহ ওই ভবন কেনার ঘোষণা দেয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। উচ্চমূল্যে ভবন কেনার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এর শেয়ারগ্রহীতাদের মধ্যে।
পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী মো. জামাল উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ভবন কেনার জন্য ব্যাংকটি উচ্চ ব্যয় করলে পরবর্তী বছরগুলোয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শেয়ারগ্রহীতাদের লভ্যাংশ কমে আসবে। অথচ এর থেকে কম ব্যয়ে একই পরিমাণ জায়গা বা ভবন কিনতে পারত ব্যাংকটি। এমনকি গুলশানেও এর থেকে কমে ভবন বিক্রি হচ্ছে। ব্যাংকটির এ সিদ্ধান্তে শেয়ারগ্রহীতাদের মুনাফা কমে আসবে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পারিবারিক সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার ক্ষেত্রে কখনও কখনও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। কেননা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পক্ষে চেয়ারম্যানের নির্দেশনার বাইরে যাওয়া কঠিন। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ভবন কেনার এ সিদ্ধান্তও চাপে পড়ে নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানি, তবে পুরোপুরিভাবে নয়। আমাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যখন পর্দার আড়ালে কাজ করার প্রবণতা থাকে, তখন ডাচ্-বাংলা খোলাখুলিভাবে তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ করার বিষয়টি আমি প্রশংসা করি। আমি জানি, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি ব্যাংক একই ভবন কেনার কথা ভাবছিল। সে ক্ষেত্রে ডাচ্-বাংলার এই ভবন কেনার ঘোষণার বিষয়ে পর্ষদের সততাকে মূল্য দিই। মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবের কারণে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই মূল্যায়ন পর্যালোচনা করবে এবং বাজার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে। সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বিশ্বাস করি, ডাচ্-বাংলা বিষয়টি ভালোভাবে তত্ত্বাবধায়ন করেছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তিক্রমকেও আইন বৈধতা দেয়, যদি তা প্রকাশ্যে আনা হয়, যেহেতু এটি ব্যাংকিং কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কিত।’
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মতিঝিলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রস্তাবিত ওই ভবনের মাত্র ২৫০ গজ দূরে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের ২২ তলা একটি নিজস্ব ভবন রয়েছে। এক লাখ ৪০ হাজার বর্গফুটের ওই ভবন নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ১১০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া কর্মসংস্থানসহ চারটি সরকারি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জন্য ২৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ২৩২ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) সম্প্রতি ৪৫০ কোটি টাকায় গুলশানে একটি ২১ তলা ভবনের ১৫ তলা কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক কারওয়ান বাজারে সার্ক ফোয়ারার পশ্চিম পাশে নিজস্ব ভবন নির্মাণ করছে। নিজস্ব জমিতে তিন বেজমেন্টসহ ১২ তলাবিশিষ্ট পাশাপাশি দুটি ভবনের নাম দেয়া হয়েছে ‘টুইন টাওয়ার’। মোট ফ্লোর স্পেসের আয়তন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার বর্গফুট। বছর দুয়েক আগে ওই ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫২৩ কোটি টাকা। একইভাবে আইএফআইসি ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকই নিজেদের জমিতে ভবন নির্মাণ করে প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এতে তাদের অনেক টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সেই পথে হাঁটতে পারছে না। বারবার ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর ভবন ভাড়া নেয়া ও কেনার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও তার পরিবার।
কেননা, ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এই উচ্চ মূল্যের লেনদেন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। সাবেক চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহমেদের মেয়ে সাদিয়া রাইন আহমেদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার মায়ের সম্পত্তি উচ্চ মূল্যে ব্যাংকের কাছে বিক্রির এ প্রক্রিয়ায় অন্যদের সম্মতি রহস্যজনক।
পর্ষদের সদস্য নোমিনি পরিচালক আবেদুর রশিদ খান, আদা তাং ইউয়েন হা, স্বতন্ত্র পরিচালক ইকরামুল হক, মোহাম্মদ সেলিম, নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিনকে উচ্চমূল্যে এই ভবন কেনার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেও কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।
এর আগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এ ভবনটি ভাড়া নিয়ে প্রধান কার্যালয় পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে আপত্তি জানায়। তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির এক বৈঠকে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন, ভাড়া না দিয়ে নিজস্ব ভবন কেনা বা নির্মাণ করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে।
জানা গেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রতি মাসে প্রায় দুই কোটি ৪৭ লাখ টাকা ভাড়া দিচ্ছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ১৪০ কোটি টাকার বেশি ভাড়া বাবদ চেয়ারম্যানের পরিবারকে পরিশোধ করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এই পাঁচ বছরে নিজেরাই ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিলে ভাড়া বাবদ উচ্চ ব্যয় কমিয়ে আনতে পারত ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। কিন্তু সেই উদ্যোগ না নিয়ে উচ্চ মূল্যে ভবন কেনার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ব্যাংকটির পর্ষদ; যা মোটেই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শেয়ার বিজ। তবে তিনি সম্প্রতি অস্ত্রোপচারজনিত চিকিৎসা নেয়ায় বেশিরভাগ সময় অফিস করেন না বলে জানা যায়। এ কারণে মতিঝিলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও এমডির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ভবন কেনার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব তথ্য যাচাই করে অনুমোদন দিলে তবেই এটি কিনতে পারবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, এ ধরনের সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বিষয় যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। ব্যাংক যেভাবে ঋণ দেয়ার সময় বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করে, সেভাবেই এ ভবনের মূল্য নির্ধারণ বা বাজার মূল্য বের করার সব প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানা রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাজার মূল্যের দ্বিগুণ দাম দিয়ে ভবন কেনার সুযোগ ব্যাংকটি পাবে বলে মনে হয় না।
ভৌত প্রকৌশলী মাহবুব শফিকুল আলম বলেন, এ ধরনের ভবন কিনতে হলে বর্তমানে বর্গফুটপ্রতি ৪০-৫০ হাজার টাকার বেশি দাম চাইতে পারেন ভবন মালিকরা। তবে নিজেরা একই ধরনের ভবন নির্মাণ করতে গেলে বর্গফুটপ্রতি ৪ হাজার থেকে ৪২০০ টাকা খরচ হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে জমির দাম।
মতিঝিলে প্রায় ৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত এই ২১ তলা ভবন কিনতে রাজি হওয়ার বিষয়ে চেয়ারম্যান সাদিয়া রাইন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে শেয়ার বিজ। তবে তিনি দেশের বাইরে থাকায় তারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
একইভাবে ব্যাংকটির বিদেশি পরিচালক আদা তাং ইউয়েন হা-কে ইমেইলের মাধ্যমে বিষয়টি অবগত করে বক্তব্য চাওয়া হয়। তিনিও ওই ইমেইলের কোনো জবাব দেননি।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো ভবনের দরদামের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। পর্ষদে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে যে দাম বলা হয়েছে, তা যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।’
ভবনটির মূল্য বেশি পড়ছে কি না বা বাজার মূল্য অনুযায়ী বেশি দাম পড়ছে কি নাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর। একটি ভবনে কী পরিমাণ জায়গা আছে তাতে আমাদের কাজ হবে কি না, লোকেশনÑএই সবকিছুর ওপর দাম নির্ভর করে।’
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি ১৭.৫ শতাংশ নগদ ও ১৭.৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর আগের বছর ১৭.৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও স্টক লভ্যাংশ দেয় ৭.৫ শতাংশ।