রিশাদ আহমেদ : যেন আকাশে একসঙ্গে দুই সূর্য উঠেছে। দুটিই আলো ছড়ায়, দুটিই উষ্ণতা দেয়; কিন্তু পথিকের প্রশ্নÑকোন সূর্যের তলায় হাঁটলে যাত্রা সহজতর হবে? প্রযুক্তির বর্তমান দিগন্তেও এমন এক দ্বৈততা জেগে উঠেছেÑএকদিকে ‘চ্যাটজিপিটি’, অন্যদিকে নতুন উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘পারপ্লেক্সিটি’। নাম শুনলেই মনে হয়, যেন বিভ্রান্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক নতুন বোধ, এক নতুন অনুসন্ধানের ধারা। মানুষের প্রশ্ন, মানুষের কৌতূহল, মানুষের জ্ঞানপিপাসাÑসবকিছুকে ঘিরে এরা যেন দুই বিশাল বৃক্ষ, যাদের ডালপালা ছায়া দেয়, ফল দেয়, আবার কাঁটাও ছড়াতে পারে।
‘চ্যাটজিপিটি’কে অনেকেই ভাবেন পরিচিত এক শিক্ষক হিসেবে, যিনি সবসময় হাতে কলম নিয়ে বসে আছেনÑপ্রশ্ন করলেই উত্তর দিয়ে দেন, আবার কথোপকথনকে সাজিয়ে তোলেন কোমল ও সহজভাবে। অপরদিকে ‘পারপ্লেক্সিটি’কে মনে হয় নতুন এক ভ্রমণসঙ্গী, যিনি শুধুই উত্তর দেন না, সঙ্গে দেন সূত্র, দেন রেফারেন্স, যেন লাইব্রেরির তাক থেকে টেনে আনেন প্রমাণস্বরূপ বই। এই দুই সঙ্গীকে একসঙ্গে পাওয়া মানে জ্ঞানের আকাশে দুই ডানা মেলে উড়তে পারা। কিন্তু মানুষ তো একসঙ্গে সব নিতে পারে নাÑকারও কাছে সময় সীমিত, কারও কাছে অর্থ। তাই দ্বিধা জš§ায়, ঠিক কোনটিকে বেছে নিলে সহজ হবে যাত্রাপথ?
সমাজের প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে প্রশ্ন কেবল উত্তর পাওয়ার নয়, বরং সঠিক উত্তর পাওয়ার নিশ্চয়তা। কেউ খোঁজেন নির্ভরযোগ্যতার আলো, কেউ চান সহজ ব্যাখ্যার ছন্দ। চ্যাটজিপিটি তার নিজস্ব সৃজনশীলতায় পাঠককে টেনে রাখে, পারপ্লেক্সিটি প্রমাণ-নির্ভরতায় বিশ্বাস জাগায়। যেন একজন গল্পকার আরেকজন গবেষকÑদুজনেই আলাদা, আবার দুজনেরই প্রয়োজনীয়তা গভীর। এই দ্বন্দ্বই মানুষকে ভাবায় শিক্ষার্থী, গবেষক, কিংবা সাধারণ পাঠকÑকোন হাত ধরলে তার গন্তব্য আরও পরিষ্কার ও ফলপ্রসূ হবে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যাত্রা একেবারে নতুন নয়। এর সূত্রপাত কয়েক দশক আগে হলেও বিগত কয়েক বছরে এর কার্যকারিতা, গতি ও ব্যাপ্তি চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের শেষ দিকে ‘চ্যাটজিপিটি’ বাজারে আসার পর মানুষের জীবনে যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা, এমনকি বিনোদনÑসব ক্ষেত্রেই এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যবহারকারীরা দেখলেন, একটি সফটওয়্যারের সঙ্গে কথোপকথন করেই পাওয়া যাচ্ছে অনুবাদ, তথ্য, ব্যাখ্যা, প্রবন্ধ, চিঠি কিংবা কোডিংয়ের সমাধান। যেন এক অদৃশ্য সহকারী সবসময় পাশে আছে। এ কারণেই অল্প সময়ের মধ্যেই কোটি কোটি মানুষ চ্যাটজিপিটির দিকে ঝুঁকলেন।
কিন্তু প্রযুক্তির বাজারে স্থবিরতা থাকে না। এক ক্ষেত্র যতই দখল করে ফেলুক, শিগগিরই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এসে হাজির হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আলোচনায় আসে ‘পারপ্লেক্সিটি’ নামের আরেক কৃত্রিম মেধা। এটি মূলত সার্চভিত্তিক এআই, যা কেবল উত্তরই দেয় না, বরং সঙ্গে রেফারেন্স, সূত্র ও প্রমাণও তুলে ধরে। অনেকের মতে, এটি ‘চ্যাটজিপিটি’র চেয়ে আলাদা ও কার্যকর, কারণ এটি শুধু কথোপকথন তৈরি করে না, বরং ইন্টারনেটের সর্বশেষ তথ্যকে নির্ভরযোগ্য আকারে হাজির করে। ফলে গবেষক, সাংবাদিক, কিংবা তথ্যনির্ভর পেশাজীবীদের কাছে ‘পারপ্লেক্সিটি’ দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাবে সাধারণ ব্যবহারকারীর মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছেÑকোনটি বেছে নিলে ভালো হবে? কেউ বলেন, চ্যাটজিপিটি সহজবোধ্য ভাষা, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীল উপস্থাপনায় অতুলনীয়। আবার কেউ বলেন, পারপ্লেক্সিটি তার তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনা ও নির্ভরযোগ্য রেফারেন্সের কারণে বেশি কার্যকর। ফলে প্রযুক্তিবিশ্বে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে ‘সুবিধা বনাম প্রমাণযোগ্যতা’Ñএকজন গল্পকার, আরেকজন গবেষক।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এর প্রভাব আরও স্পষ্ট। শিক্ষার্থীরা এখন কেবল বই নয়, এআইকে সঙ্গী করে পড়াশোনা করছে। চাকরিপ্রার্থীরা প্রস্তুতির সময় এআইয়ের সাহায্য নিচ্ছেন, সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই করছেন এবং উদ্যোক্তারা ব্যবসার কৌশল খুঁজে পাচ্ছেন। একদিকে মানুষ সহজভাবে শেখার জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছেন, অন্যদিকে নির্ভরযোগ্যতার নিশ্চয়তার জন্য পারপ্লেক্সিটির দিকে তাকাচ্ছেন।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, মানুষ কি সৃজনশীলতা চাইবে, নাকি নির্ভরযোগ্যতা? ভবিষ্যৎ কী হবেÑএকক কোনো এআইয়ের জয়, নাকি সহাবস্থান? প্রযুক্তি আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত একেবারেই ব্যবহারকারীর হাতে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে চ্যাটজিপিটি-পারপ্লেক্সিটির প্রতি ব্যবহারকারীদের টান ও প্রত্যাশা কী, সে বিষয়টি মেপেছে বিভিন্ন সমীক্ষা ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ। যদিও সরাসরি চ্যাটজিপিটি-পারপ্লেক্সিটি নিয়ে ব্যাপক জনমতভিত্তিক সমীক্ষা এখনো সীমিত, তবু প্রযুক্তি-বিশ্লেষক, নিউজ আউটলেট ও শিক্ষার্থীদের মতামত থেকে কিছু মূল ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্লেষক ও প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগে (যেমন: ঝঊ জধহশরহম, বডববশ, তধঢ়রবৎ) এই দুই প্ল্যাটফর্মের মূল পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছেÑচ্যাটজিপিটির মানবসদৃশ কথোপকথন, সৃজনশীল লেখা, মাল্টিমিডিয়া (ছবি, কোড) তৈরিতে দক্ষ; আর পারপ্লেক্সিটি তথ্যভিত্তিক, রিয়েল-টাইম ওয়েব-সার্চ, উৎস প্রদান এবং নির্ভরযোগ্যতা-নির্ভরতায় এগিয়ে। ঞড়স’ এঁরফব-এ করা একটি ‘৭টি প্রম্পট টেস্ট’-এ দেখা গেছে, রিয়েল-টাইম তথ্য: চবৎঢ়ষবীরঃঃৎঁপঃৎবফ তথ্য ও চার্টসহ দিচ্ছে, আর ঈযধঃএচঞ বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট যোগ করে।
কোডিং: চবৎঢ়ষবীরঃু শিক্ষামূলকভাবে স্পষ্ট, ##ঈযধঃএচঞ দীর্ঘমেয়াদি কাজের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর ।
গাণিতিক সমাধান: ঈযধঃএচঞ দ্রুত সহজভাবে, চবৎঢ়ষবীরঃু ধাপে ধাপে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে।
সৃজনশীল লেখা ও অনুবাদ: চ্যাটজিপিটি কবিতা আর অনুভূমিক গভীরতায় এবং পারপ্লেক্সিটিতে পাঠযোগ্যতা ও গঠনযোগ্যতা বেশি প্রাধান্য পায়।
কেন ব্যবহারকারীরা চ্যাটজিপিটি-পারপ্লেক্সিটি বেছে নেবেন, তা শুধু জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে না; বরং বাস্তব প্রয়োগ ও প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, প্রতিদিনের জীবনে মানুষ দুই ধরনের তথ্যের খুঁজে থাকেÑএকটি হলো দ্রুত, সহজবোধ্য ও সৃজনশীল ব্যাখ্যা; অন্যটি হলো নির্ভরযোগ্য, প্রমাণভিত্তিক তথ্য। চ্যাটজিপিটি প্রথম দিকের ক্ষেত্রে কার্যকর। এটি মানুষের মতো কথোপকথন চালাতে পারে, লেখাপত্র সাজাতে পারে, কোড বা গল্প তৈরি করতে পারে। ফলে শিক্ষার্থী, লেখক বা সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য এটি সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং সময় সাশ্রয় করে।
অন্যদিকে পারপ্লেক্সিটি মূলত তথ্যের নির্ভুলতা ও উৎসের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। গবেষক, সাংবাদিক বা ব্যবসায়ীরা যাদের সঠিক তথ্য প্রয়োজন, তারা পারপ্লেক্সিটিকে প্রাধান্য দেন। কারণ এটি শুধু উত্তর দেয় না, সঙ্গে উৎসও দেখায়; ফলে ব্যবহারকারী নিশ্চিত থাকতে পারেন তথ্যটি যাচাইযোগ্য।
বাস্তবতার দিক থেকে এটি একটি লজিক্যাল বাছাইও হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমরা দ্রুত কোনো ধারণা বা উদাহরণ চাই, তখন চ্যাটজিপিটি; আর যদি নিশ্চিত তথ্য ও প্রমাণভিত্তিক উত্তর দরকার হয়, তখন পারপ্লেক্সিটি। এমনভাবে দেখা যায়, দুটি এআই পরস্পরের ঘাটতি পূরণ করে। তাই ব্যবহারকারীরা প্রায়ই কাজের ধরন অনুযায়ী একটিকে বেছে নেন, কিংবা দুটোই প্রয়োগ করেনÑএকটি সৃজনশীলতা এবং সময় সাশ্রয় দিচ্ছে, অন্যটি নির্ভরযোগ্যতা ও তথ্যভিত্তিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করছে।
এই প্রযুক্তিদ্বৈততার মধ্য থেকে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো ব্যবহারের লক্ষ্য অনুযায়ী এআই নির্বাচন। ব্যবহারকারীদের উচিত, আগে নিজের প্রয়োজন নির্ধারণ করা, তথ্য যাচাই, গবেষণা বা প্রামাণ্য প্রতিবেদনের জন্য চবৎঢ়ষবীরঃু বেছে নেওয়া, আর সৃজনশীল লেখা, কোডিং, চিত্রকলা বা সাধারণ কথোপকথনের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা। এভাবে প্রতিটি এআইয়ের শক্তি অনুযায়ী কাজে লাগানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, দুটিকেই সমন্বয়ে ব্যবহার করা একটি বাস্তবিক ও লজিক্যাল সমাধান। ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী কোনো প্রবন্ধ লিখছে। প্রথমে পারপ্লেক্সিটি ব্যবহার করে তথ্য ও উৎস যাচাই করবে, পরে চ্যাটজিপিটি দিয়ে ভাষা সাজানো, অনুবাদ বা উদাহরণ সংযোজন করা যেতে পারে। এতে সময় সাশ্রয় হয় এবং নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে সৃজনশীলতাও বজায় থাকে।
তৃতীয়ত, সচেতন ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। ব্যবহারকারীদের উচিত এআইয়ের দেয়া তথ্য প্রথমেই বিশ্বাস না করা। উৎস যাচাই, যুক্তি বিশ্লেষণ এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশেষ করে সাংবাদিক, গবেষক বা শিক্ষাবিদরা যাতে ভুল তথ্যের ফাঁদে না পড়ে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থীদের এআইয়ের ব্যবহার শেখানো উচিতÑকখন কোনটি ব্যবহার করা হবে, তথ্য যাচাই ও কনটেক্সট বোঝা, এমনকি এদের সীমাবদ্ধতাও জানানো। এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহারকে আরও ফলপ্রসূ করবে।
সর্বোপরি প্রযুক্তির সুবিধা নেয়া মানেই দারুণ সম্ভাবনার দ্বার খোলা। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সচেতন ব্যবহার ছাড়া ফলাফল পুরোপুরি লাভজনক হবে না। চ্যাটজিপিটি-পারপ্লেক্সিটি উভয়ই ঠিকমতো ব্যবহার করলে তথ্যনির্ভরতা ও সৃজনশীলতার মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য তৈরি সম্ভব।
প্রযুক্তির দুনিয়ায় এককভাবে কোনো এআই’কে সর্বোত্তম বলা ঠিক হবে না। চ্যাটজিপিটি মানুষের মতো কথোপকথন ও সৃজনশীলতায় অসাধারণ, কিন্তু তথ্য যাচাই বা উৎসনির্ভরতায় পারপ্লেক্সিটির তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, উভয় এআই একসঙ্গে ব্যবহার করা সবচেয়ে কার্যকর। প্রয়োজন অনুযায়ী একটি ব্যবহার করা যায়, বা সমন্বয়ে ব্যবহার করলে সৃজনশীলতা, তথ্যভিত্তিক অবস্থা ও সময় সাশ্রয়Ñতিনটিই সম্ভব। ব্যবহারকারীদের উচিত, সচেতন থাকা, এআইয়ের প্রদত্ত তথ্য যাচাই করা এবং নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা।
এককথায়, প্রযুক্তি মানুষের সঙ্গী, কিন্তু সিদ্ধান্তের দায়িত্ব মানুষের ওপরই। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটির যেকোনো বাছাই তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন ব্যবহারকারী তার প্রয়োজন, লক্ষ্য ও বাস্তবতার সঙ্গে এআইয়ের শক্তি মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাস্তব জীবনের সমস্যার জন্য এআই শুধু সহায়ক, সিদ্ধান্তের পথ দেখায়, কিন্তু পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ মানুষের।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়