আমানুর রহমান খোকন, কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের ২৫০ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও আবাসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ২৪ ঘণ্টায় থাকছেন একজন ৯ম গ্রেডের ডাক্তার। জেলার প্রধান এ সরকারি হাসপাতালের একমাত্র ভরসা এখন ডিপ্লোমা, প্যারামেটিক ও ইন্টার্ন করতে আসা ছাত্ররা। জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় একজন মেডিকেল অফিসার (এমবিবিএস) মানের ডাক্তার থাকার বিধান থাকায় ৮ ঘণ্টা ডিউটি হিসেবে ২৪ ঘণ্টায় তিনজন ডাক্তারের ডিউটি বদল করা হয়। আর এই ৯ম গ্রেডের একজন ডাক্তারকে সামলাতে হয় জরুরি বিভাগ, আট তলা ভবন ও পুরোনো ভবনের সব রোগীর। কুড়িগ্রামের মঙ্গাপ্রবণ মানুষদের জন্য এ হাসপাতালের ডাক্তার স্বল্পতা কোনোভাবেই কাটছে না। হাসপাতালে ডাক্তার স্বল্পতায় চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছেন ডিএমএফ, প্যারামেটিক ও ইন্টার্ন ছাত্ররা। এতে হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জনবল সংকট দীর্ঘ দিনের। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের এ হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ এবং পরে তা ২৫০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। আগের ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই এক যুগ ধরে চলছে জেলার প্রধান এ হাসপাতালটি। বর্তমানে ইনডোরে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকছেন ৩০০ থেকে ৪০০ জন। শুক্রবার বাদে আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ রোগী তাদের চিকিৎসা নিতে আসেন এবং জরুরি বিভাগে প্রতিদিন রোগী আসেন প্রায় ৩০০ জন। জরুরি বিভাগের কিছু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিলেও আবার কিছু রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। এ হাসপাতালের রোগীর উপস্থিতি অনুযায়ী ১১২ জন ডাক্তারের প্রয়োজন থাকলেও এখন রয়েছে সব মিলে শুধু ১৬ জন। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসার রয়েছেন পাঁচজন। জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সেবা দিতে মেডিকেল অফিসার দরকার কম পক্ষে তিনজন। বর্তমানে কর্মরত পাঁচজন মেডিকেল অফিসার একইসঙ্গে ইনডোর, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ সামলাতে হচ্ছে। সকার ৯টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত হাসপাতালের আউটডোর, ইনডোর ও জরুরি বিভাগে একাধিক ডাক্তার থাকলেও দিনের বাকি সময় এবং পুরো রাতের জন্য শুধু থাকেন জরুরি বিভাগের একজন ৯ম গ্রেডের ডাক্তার। এরপরও এই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসাররা জরুরি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেই ব্যক্তিগত চেম্বার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে প্রতিদিন ৫০০-৭০০ টাকা ভিজিট নিয়ে নিয়মিত রোগী দেখার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর অভিভাবক, হায়দার আলী ও রফিক মিয়া বলেন, অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতালে এসেছি, জরুরি বিভাগে কোনো মেডিকেল অফিসার নেই। শুনালাম তিনি ছয় তলায় গিয়েছেন আবাসিক রোগী দেখার জন্য। ইন্টার্ন ছাত্র ও ডিপ্লোমা চিকিৎসক আমাদের রোগীকে ভর্তি করিয়ে নিলেন। তারা কীসের চিকিৎসাপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন তাও কিছুই বুঝলাম না। রোগীর স্বজন নাহিদা পারভীন ও শেফালী বেগম বলেন, এ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে দিনের বেলায় কিছু কিছু সময় মেডিকেল অফিসার থাকলেও রাতের বেলায় থাকেন না। ওয়ার্ডের কোনো রোগী বেশি অসুস্থ হলে জরুরি বিভাগ থেকে ডাক্তার আসার আগেই অনেক রোগী মারা যান।
জরুরি বিভাগের ডাক্তার স্বপন কুমার বলেন, আমার ডিউটি আড়াইয় শুরু হয়েছে। আমাকে একাই পুরো হাসপাতালের রোগীর সেবা দিতে হচ্ছে। আমার ৮ ঘণ্টা ডিউটিতে জরুরি বিভাগের প্রায় দেড়শ থেকে দুইশত রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে। এর মধ্যে নতুন ও পুরোনো ভবনের ভর্তি রোগী দেখার জন্য কয়েকবার যেতে হবে। জরুরি বিভাগের আকেক ডাক্তার আব্দুল হান্নান বলেন, আমি ৯ গ্রেডে চাকরি করায় জরুরি বিভাগের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দুপুরের পর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত জরুরি বিভাগের একজন ডাক্তার ছাড়া কোনো এমবিবিএস বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকেন না এই হাসপাতালে। যার ফলে জরুরি বিভাগের ডিউটিরত ডাক্তারকে জরুরি বিভাগ, শিশু, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, পুরোনো ভবনের সার্জারি ওয়ার্ড, লেবার ওয়ার্ড ও ডায়রিয়া রোগী দেখাসহ অনেক কাজ করতে হয়।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শহিদুল্লা লিংকন বলেন, আমাদের হাসপাতালের জনবল সংকটের সমস্যা অনেক দিনের। মেডিকেল অফিসার মাত্র পাঁচজন আছেন। তাদের আউটডোর, ইনডোর ও জরুরি বিভাগের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন কমবেশি ময়নাতদন্ত ও মামলার সাক্ষী দিতে হাসপাতালের বাইরে যেতে হয়। তারপরও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবা থেমে নেই। যদি কোনো ডাক্তার ডিউটি ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখেন তাদের বিরুদ্ধে বিধিমত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

Discussion about this post