ড. মতিউর রহমান
২০২৫ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত”দ্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস রিপোর্ট ২০২৫”বিশ্বজুড়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রগতিকে বিশদভাবে তুলে ধরেছে। ২০৩০ সালের এজেন্ডা অনুযায়ী, এই প্রতিবেদনটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি কঠোর বাস্তবতা উপস্থাপন করেছে—মাত্র ৩৫ শতাংশ এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে বা মাঝারি অগ্রগতি দেখাচ্ছে; প্রায় ৫০ শতাংশ লক্ষ্য স্থবির বা ধীর গতিতে চলছে, এবং উদ্বেগজনকভাবে ১৮ শতাংশ লক্ষ্য ২০১৫ সালের সূচকের নিচে নেমে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে একটি বৈশ্বিক উন্নয়ন জরুরি অবস্থা হিসেবে আখ্যায়ি়ত করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রতিবেদনটি শুধু বৈশ্বিক তথ্যের সমষ্টি নয়, বরং এটি একটি সুস্পষ্ট আয়না, যা দেশের শক্তি, দুর্বলতা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলোকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে।
২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, মেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার বৃদ্ধি, বিদ্যুতায়নের ব্যাপক বিস্তার এবং নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনমূলক প্রকল্পগুলো দেশের উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন—এগুলো বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অর্জন।
তবে জাতিসংঘের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট যে, জলবায়ু পরিবর্তন, কভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক ঋণচাপ এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে সৃষ্ট বহুমাত্রিক সংকট বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি এবং জ্বালানি মূল্যের অস্থিরতা—এগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই সংকটগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এসডিজি অর্জনের পথকে আরও দুর্গম করে তুলেছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে ছয়টি মূল খাতকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা জরুরি। এই খাতগুলো হলো: খাদ্য ব্যবস্থা, জ্বালানি প্রবেশাধিকার, ডিজিটাল সংযুক্তি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা এবং জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই প্রতিটি খাতই গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু অগ্রগতি সাধিত হলেও কাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে।
১. খাদ্য ব্যবস্থা: নিরাপত্তা থেকে পুষ্টির দিকে উত্তরণ
বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা নিঃসন্দেহে একটি বিশাল অর্জন এবং দেশের খাদ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটি দেশের কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণে সহায়তা করেছে। কিন্তু পুষ্টির বিচারে চিত্রটি ভিন্ন। এখনও শিশুর অপুষ্টি (বিশেষ করে খর্বাকৃতি ও রুগ্ণতা), নারীর খাদ্য বৈচিত্র্যের ঘাটতি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব) এবং নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে (যেমন চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা) খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী প্রতি ১১ জনে ১ জন অনাহারে ছিলেন এবং ২৩০ কোটিরও বেশি মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন।
বাংলাদেশের ছোট কৃষক, যারা দেশের খাদ্য উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি, তারা বছরে গড়ে ৫০০ মার্কিন ডলারের কম আয় করেন এবং কৃষি বিমা, আধুনিক প্রযুক্তি ও বাজার সংযোগে পিছিয়ে রয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা কৃষকদের জীবন-জীবিকাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। কৃষি খাতে ন্যায্য বিনিয়োগের অভাব এবং পুষ্টিকেন্দ্রিক খাদ্য নীতির অনুপস্থিতি স্পষ্ট। এর ফলে এসডিজি ২ (ক্ষুধামুক্তি) অর্জনে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে কৃষকদের ক্ষমতায়ন, পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য অপচয় হ্রাস এবং সবার জন্য খাদ্য সহজলভ্য করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ এবং জলবায়ু-সহনশীল ফসল উৎপাদনে জোর দেয়া অপরিহার্য।
২. জ্বালানি প্রবেশাধিকার: পরিচ্ছন্ন শক্তির দিকে রূপান্তর এবং টেকসই সমাধান
বিদ্যুৎ সংযোগের বিস্তার নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি বড় সফলতা। দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে, যা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আলোকিত হয়েছে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার এখনও সীমিত। গ্রামীণ এলাকায় জ্বালানির জন্য কাঠ, খড় বা কেরোসিন ব্যবহার আজও সাধারণ, যা নারী ও শিশুদের (বিশেষ করে রান্নাঘরের ধোঁয়ার কারণে) স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে এবং পরিবেশগত ক্ষতি ডেকে আনে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, বৈশ্বিকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ বৃদ্ধি পেলেও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে রূপান্তর ধীরগতিতে হচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন শক্তি নীতিমালায় পরিবেশবান্ধবতা, সমতা ও জ্বালানি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে—যার জন্য প্রয়োজন নবায়নযোগ্য শক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ (যেমন সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, বায়োমাস), সবুজ প্রযুক্তির উদ্ভাবন (যেমন উন্নত চুলা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট) এবং জ্বালানি ভর্তুকির কাঠামো সংস্কার। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌর ও বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য উৎসগুলোর ব্যবহার বাড়ানো অপরিহার্য। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দক্ষ জনবল তৈরি করা জরুরি।
৩. ডিজিটাল সংযুক্তি: ডিজিটাল বিভাজন দূরীকরণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অনলাইন সংযোগের হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ই-গভর্ন্যান্স, মোবাইল ব্যাংকিং, টেলি-মেডিসিন এবং অনলাইন শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। সরকারি সেবা প্রদান, আর্থিক লেনদেন এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণ মানুষের জীবন সহজ করেছে।
তবে ডিজিটাল বিভাজন আজও প্রবল। গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারী ও প্রবীণরা, ডিজিটাল শিক্ষা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছেন। ইন্টারনেট অবকাঠামো, উচ্চমূল্য এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এই বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এই বৈষম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিজিটাল সক্ষমতা ছাড়া এসডিজি ৯ (শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো) বা এসডিজি ৪ (গুণগত শিক্ষা) সফল হবে না। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি (বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য), কম দামে ইন্টারনেট সরবরাহ (বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়), এবং সবার জন্য নিরাপদ ও ন্যায্য ডিজিটাল পরিসর নিশ্চিত করা। শহরের সুবিধাভোগী এবং গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান এই ব্যবধান কমাতে না পারলে ডিজিটাল অগ্রগতির সুফল সবার কাছে পৌঁছাবে না এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।
৪. শিক্ষা খাত: মান, সমতা ও অন্তর্ভুক্তির চ্যালেঞ্জ
শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ প্রাথমিক পর্যায়ে লিঙ্গসমতা অর্জন করেছে এবং বিদ্যালয় ভর্তির হার বেড়েছে, যা প্রশংসনীয়। মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশ অনেক দেশের জন্য মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে গভীর উদ্বেগ আছে। করোনাকালে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকার প্রভাব এখনও কাটেনি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান, পাঠ্যবই বোঝার ক্ষমতা এবং গণিত দক্ষতা আশানুরূপ নয়। শিক্ষকের মান, আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির অভাব এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা শিক্ষার গুণগত মানকে ব্যাহত করছে।
গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার বেশি, বিশেষ করে কিশোরীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে। শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং পরিবেশগত ও প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এসডিজি ৪ (গুণগত শিক্ষা) অর্জনের জন্য শিক্ষার মান উন্নয়ন, অসমতা হ্রাস এবং সকলের জন্য মানসম্পন্ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এর জন্য পাঠ্যক্রম সংস্কার, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতাভিত্তিক উন্নয়নে জোর দেয়া প্রয়োজন।
৫. কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা: দারিদ্র্য বিমোচনের নতুন কৌশল
কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। দেশের সিংহভাগ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে নিয়মিত আয়, ছুটি, পেনশন বা স্বাস্থ্যসেবা নেই। এই খাতের শ্রমিকরা প্রায়শই স্বল্প মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন। যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শ্রম বাজারে দক্ষতা ও চাহিদার মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে।
যদিও কিছু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প (যেমন বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা) চালু আছে, কিন্তু এগুলোর আওতা সীমিত এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ৯.৭ শতাংশ জনগণ সামাজিক সুরক্ষা সুবিধার আওতায় রয়েছে। বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং জবাবদিহিমূলক সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন (বিশেষ করে তরুণদের জন্য), এবং সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো এসডিজি ৮ (শালীন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) অর্জনের জন্য অপরিহার্য। এর জন্য এসএমই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম আইন সংস্কার এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন।
৬. জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ: অস্তিত্বের সংকট ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা
জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বাস্তবতা। ২০২৪ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গরম বছর এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ২০ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাগুলো ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
জলবায়ু উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি দূরদর্শী উদ্যোগ হলেও এর বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা আসছে না। উন্নত দেশগুলো এখনও তাদের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। বাংলাদেশের জলবায়ু অভিযোজন কৌশলকে সফল করতে হলে আন্তর্জাতিক জলবায়ু ন্যায়বিচার, স্থানীয় অভিযোজন প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং পরিবেশ-সচেতন জনমত গঠন জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা এসডিজি ১৩ (জলবায়ু কার্যক্রম), এসডিজি ১৪ (জলজ জীবন) এবং এসডিজি ১৫ (স্থলজ জীবন) এর মূল লক্ষ্য। এর জন্য কার্বন নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক প্রচেষ্টা, উন্নত দেশগুলোর অর্থায়ন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
সবচেয়ে অবহেলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যবস্থা। সঠিক ও সময়োপযোগী তথ্য ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ সম্ভব নয়। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো আজও দাতানির্ভর তথ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। ২০২৫ সালে ইউএসএইডএর অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৩৯টির বেশি এসডিজি সূচক ঝুঁকিতে পড়েছে। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়। মাতৃত্ব স্বাস্থ্য, শিশুর পুষ্টি, শহরের বস্তি ও নারীর সহিংসতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশ নিজস্ব তথ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলে—জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তথ্য উন্মুক্ত করে এবং গবেষণা ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে যৌথভাবে ডেটা জেনারেশনকে শক্তিশালী করে। ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এসডিজি অর্জনের পথকে সুগম করবে। নির্ভুল ও সময়োপযোগী ডেটা সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
শাসনব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা এসডিজির সার্বিক সফলতার মূলে। এসডিজি ১৬ শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান—বাকি সব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহায়ক। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ছাড়া এসডিজি অর্জন অসম্ভব। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সরকারি সেবার মান উন্নত হবে এবং দুর্নীতি হ্রাস পাবে, যা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একটি টেকসই সমাজ গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক।
২০২৫ সালের এই জাতিসংঘ প্রতিবেদন একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে—২০৩০-এর সময়সীমা আর দূরে নেই, কিন্তু সম্ভবনা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ একটি যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। তার অতীত সাফল্য গর্বের, কিন্তু ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, কাঠামোগত সংস্কার এবং বৈশ্বিক সহমর্মিতা। এই পাঁচ বছর কেবল একটি সময়ের গণ্ডি নয়—এটি একটি দায়, একটি প্রতিশ্রুতি এবং কোটি মানুষের ভাগ্য গঠনের সুযোগ।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষ—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে এগিয়ে আসতে হবে, বিশেষ করে জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে।
এই কঠিন সময়ে, বাংলাদেশের প্রয়োজন উদ্ভাবনী সমাধান এবং স্থিতিশীল নীতি। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, সামাজিক সমতা, পরিবেশগত স্থায়ি়ত্ব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতে নিয়ে আসা, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।
প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশ কি সাহসী পথে এগিয়ে যাবে, নাকি স্থবির উন্নয়নের চক্রে আটকে পড়বে? এই চূড়ান্ত লড়াইয়ে জয়ী হতে হলে আমাদের শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই চলবে না, বরং নিরলস প্রচেষ্টা এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়ি়ত্ব আমাদের সবার।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী