শেখ শাফায়াত হোসেন : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে অভিনব এক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে একটি চক্র বড় অঙ্কের একটি ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে জালিয়াতি ধরা পড়ায় কাজটি পায়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
দরপত্রের সূত্র থেকে জানা যায়, অভিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স সরকার কবির আহমেদ। টেন্ডার আইডি নং: ১০৬০৯১৭। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তিনটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেন সরবরাহ করতে চেয়েছিল।
এই কাজটি পেতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি একটি অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ডোমেইন কিনে ওয়েবসাইট বানায় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের নির্দেশনা অনুযায়ী দরপত্র জমা দেয়। অধিদপ্তরের কারিগরি স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে মিল থাকায় প্রাথমিকভাবে কার্যাদেশও পায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি। তবে পরবর্তী যাচাইয়ে জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়ে।
প্রকল্প এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেন সংগ্রহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। ওই টেন্ডারে ‘লিহোত্রা’ নামে তুরস্কের একটি ব্র্যান্ডের ক্রেন সরবরাহের প্রস্তাব দেয় মেসার্স সরকার কবির আহমেদ। ওই ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইটে (িি.িষরযড়ঃৎধ.পড়স) শুধু একটি ক্রেনের বিবরণ দেয়া ছিল। যে বিবরণের সঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দরপত্রের কারিগরি স্পেসিফিকেশন হুবহু মিলে যায়। তবে ওই ব্র্যান্ড সম্পর্কে ইন্টারনেটে তথ্য যাচাই করে অন্য কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। এ থেকে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ জাগে। তারা তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সেই কমিটি অধিকতর তদন্ত করার জন্য সহায়তা নেয় সরকারের আরও দুটি মন্ত্রণালয়ের। সব তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। তবে অজ্ঞাত কারণে জালিয়াতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়।
তদন্তের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা ও প্রশিক্ষণ) নাহিদ সুলতানা মল্লিককে সভাপতি করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় গত ৬ মে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও গত ১৯ মে প্রথমবারের মতো বৈঠক করে কমিটি। বৈঠকে আনীত অভিযোগের বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। পরে তারা অধিকতর তদন্তের জন্য সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি বিভাগে চিঠি দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাস লিহোত্রা নামের ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পায়নি। ফলে মেসার্স সরকার কবিরের জালিয়াতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একই রকম প্রতিবেদন দেয় আইসিটি বিভাগও।
এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চার দফা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান। তাতে বলা হয়, অভিযোগের সত্যতা রয়েছে; যা প্রতারণামূলক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়। বিধি মোতাবেক কার্যাদেশ বাতিল করা যেতে পারে। আগামী তিন বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে এবং পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পাঠানো যেতে পারে।
তবে এমন সুপারিশ করার পর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্তমানে লিহোত্রা ডটকম ওয়েবসাইটটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
জালিয়াতি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, তা জানতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাতে সাড়া দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেসার্স সরকার কবির আহমেদ নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির অফিসের ঠিকানা ৩১ বীর উত্তম কে এম সাইফুল্লাহ রোড, গ্রিন রোড, ঢাকা। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কাস্টমসের তথ্য ভাণ্ডারে যুক্ত হয় ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল। এরপর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি দেশের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে আমদানিকৃত পণ্য সরবরাহের কাজ পেয়েছে বলে জানা যায়।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, টেন্ডার প্রক্রিয়া ডিজিটাল হলেও সব তথ্য যাচাই না করলে জালিয়াতির সুযোগ থেকে যায়। এখানে ওয়েবসাইটটিকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, অথচ গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে এটি যে জালিয়াতির কৌশল, তা স্পষ্ট।
সরকারি টেন্ডার ব্যবস্থাপনায় তথ্য যাচাই ও নিরাপত্তা ঘাটতির সুযোগেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কোনো কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে সচিবালয়ে।

Discussion about this post