নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের (এসসিবি) ক্রেডিট কার্ড থেকে গ্রাহকের অজান্তেই অর্থ স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে। এবার গ্রাহকদের টাকা যাতে নিরাপদে থাকে সে জন্য কার্ড অপশন বন্ধ করল ব্যাংকটি।
এই ব্যাংকের গ্রাহকরা এখন থেকে যে কোনো সময় তাদের এসসি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে বিকাশে টাকা স্থানান্তর করতে পারবেন। তবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করার স্বার্থে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অ্যাপ থেকে ‘অ্যাড মানি’ অপশন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়, গ্রাহকরা চাইলে এসসি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকাশে অর্থ পাঠাতে পারবেন। তবে সরাসরি এমএফএস অ্যাপ থেকে ‘অ্যাড মানি’ সুবিধা আপাতত চালু থাকছে না।
ব্যাংক জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যাতে গ্রাহকদের লেনদেন আরও নিরাপদ থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ফি ও চার্জের তথ্য জানতে গ্রাহকদের নির্দিষ্ট লিঙ্কে ভিজিট করতে বলা হয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও নিরাপত্তা জোরদার করতে সাময়িক এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই গ্রাহকরা পূর্ণাঙ্গ সেবা আবার স্বাভাবিকভাবে পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের একাধিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। হঠাৎই তাদের ফোনে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) মেসেজ আসার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাংক কার্ড থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা গায়েব হয়ে যায়। অথচ কোনো ব্যবহারকারীই ওটিপি শেয়ার করেননি, কিংবা সন্দেহজনক ওয়েবসাইট/অ্যাপ ব্যবহার করেননি। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এ ঘটনায় দায় স্বীকার না করে সরাসরি বলেছে, ব্যাংকের সিস্টেমগুলো, যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত, কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। একইসঙ্গে এ ঘটনায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে (যেমন বিকাশ, নগদ) ডিজিটাল লেনদেনের ওপর দায় চাপিয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
গত ২৬ আগস্ট ভুক্তভোগী হাসিন হায়দার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ভিসা কার্ড থেকে হঠাৎ ৫০ হাজার টাকা কেটে নেয়া হয়েছে বিকাশ অ্যাকাউন্টে। ফোনে ওটিপি এলেও আমি তা কারও সঙ্গে শেয়ার করিনি। তারপরও ২০ সেকেন্ডের মধ্যে টাকা স্থানান্তর হয়ে যায়। অথচ ব্যাংক বলছে, যেহেতু ওটিপি দিয়ে লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে, তাই এটা গ্রাহকের দায়।’
হাসিন হায়দার তার ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আরও লিখেছেন, ‘২৬ আগস্ট রাত ৭টা ৪৩ মিনিটে আমার কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা কেটে নেয়া হয়। আমি ওটিপি কারও সঙ্গে শেয়ার করিনি। আমার বিশ্বাস, এটা ব্যাংকের সিকিউরিটি ইস্যু।’
হাসিন হায়দার লিখেছেন, ‘আগস্টের ২৬ তারিখ রাত ৭টা ৪৩ মিনিটে আমার ফোনে হঠাৎ দুটি ওটিপি আসে। এর ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই দেখি আমার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ভিসা ক্রেডিট কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা বিকাশ অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। অথচ কেউ আমার কাছে ওটিপি চায়নি, ফোন বা কম্পিউটার কারও হাতে ছিল না এবং আমি নিজেও কোথাও এটি ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ একেবারে চোখের সামনে আমার টাকা উধাও হয়ে গেল।’
হাসিন হায়দার লিখেছেন, ‘ঘটনার পরপরই কার্ড ব্লক করার জন্য আমি ব্যাংকের হেল্পলাইনে ফোন দিই। কিন্তু সেখানে ঢুকতে যেন যুদ্ধ করতে হলো। মিনিটের পর মিনিট ওয়েট করেও কেউ রিসিভ করছিল না। অবশেষে একজন এজেন্ট ধরলেন এবং বললেন, ট্রানজেকশন যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এখনই কমপ্লেইন নেয়া যাবে না। স্টেটমেন্ট আসা পর্যন্ত (২-৩ দিন) অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আবার ফোন দিলে আরেকজন এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গেই আমার অভিযোগ নেন এবং কেস নম্বর দেন: ২০২৫০৮২৬৯৭৮৫৪৩। এখানেই বোঝা যায়, ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিস কতটা অসংগঠিত।’
হাসিন হায়দার আরও লিখেছেন, ‘পাঁচ দিন পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হলোÑযেহেতু ওটিপি ব্যবহার হয়েছে, তাই ব্যাংকের কিছু করার নেই। অথচ আমি স্পষ্ট জানালাম, আমার ফোন থেকে বা অন্য কোথাও থেকে কোনোভাবেই ওটিপি শেয়ার হয়নি। এটা স্পষ্টতই ব্যাংকের দিক থেকে নিরাপত্তা ভঙ্গ বা তথ্য ফাঁসের ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘আমি ২০০৯ সাল থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছি। এত দিনে এটাই আমার প্রথম ফ্রড কেস। আমি যথেষ্ট নিরাপত্তা সচেতন। অবিশ্বস্ত কোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে কার্ড ব্যবহার করি না। তাই নিশ্চিতভাবেই এই ঘটনাটি গ্রাহকের নয়, ব্যাংকের দিকের নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে ঘটেছে।’
হাসিন হায়দার আরও লেখেন, ‘এরপর খুঁজে দেখলাম, লিংকডইন ও ফেসবুকে আরও অনেক গ্রাহক ঠিক একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাদের কারও কাছ থেকেও ওটিপি শেয়ার হয়নি। অথচ তাদেরও টাকা একইভাবে উধাও হয়েছে এবং সবার ক্ষেত্রেই স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের কার্ড ব্যবহƒত হয়েছে। তাহলে কি এটা ব্যাংকের সিস্টেমেটিক নিরাপত্তা ত্রুটি নয়।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককেও জানিয়েছি। তাদের তদন্ত ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। ঘটনার পর (সেপ্টেম্বর ৫ তারিখ বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে) স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের হেড অব রিটেইল ব্রাঞ্চেস আমাকে ফোন করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জানান, বিষয়টি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়া হয়েছে। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) থেকে বিকাশ/নগদসহ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হবে।’
শুধু হাসিন হায়দার নন, আরও অনেকে একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও অন্তত কয়েকজন গ্রাহক একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। সংখ্যাটা ১০০-এরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘জালিয়াত চক্র সব সময় ওঁত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ব্যাংককে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে গ্রাহকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়, বিশেষ করে পিন বা পাসওয়ার্ড কখনও কারও সঙ্গে শেয়ার না করতে।
আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করে থাকি। সাম্প্রতিক সময়ে জালিয়াত চক্র বিশেষভাবে এসএমই গ্রাহকদের টার্গেট করছে। তাই গ্রাহকদের সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনই ব্যাংকগুলোকেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।’
বাংলাদেশে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড অন্যতম শীর্ষ নাম। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাংককে তুলনামূলক নিরাপদ ও বিশ্বস্ত ধরা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক এ অভিযোগে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহক আস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

Discussion about this post