Print Date & Time : 15 September 2025 Monday 9:29 am

জীবনমান উন্নয়নে সাহিত্যের প্রভাব

জাহিদ হাসান : সাহিত্য নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে বরাবরই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে সাহিত্য কেবলই কল্পনার বাতাবরণে রচিত এক রঙ্গতামাশার বিষয়, যা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য চিত্তবিনোদন দিয়ে থাকে এবং যার অতিরঞ্জিত কল্পনা মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সাহিত্য নিয়ে মানুষের এমন ধারণা আজকের নয়, সেই সুদূর অতীতের দুই দার্শনিক এরিস্টটল ও প্লেটোর সাহিত্য তত্ত্ব প্রকাশের পর থেকেই এটা নিয়ে নানা সমালোচনার ঝড় উঠে আসছে। তবে সাহিত্য নিয়ে এমন নেতিবাচক ধারণা আপাতত মেনে নিলেও জীবনমান উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

সাহিত্যের প্রায় সবগুলো শাখাই মানুষের জীবনকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। কবি হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য, মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে: কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।”একজন লেখক সাহিত্য লেখার সময় তার জীবন অভিজ্ঞতা ও জানার পরিধিকে আশ্রয় করেই লেখে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু জীবনের নানা মাত্রিকতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। সাহিত্য পাঠ করে একজন পাঠক জীবনের নানা মনস্তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে। বিষয়বস্তুর সঙ্গে লেখকের শিল্পগুণ ও কৌশল যুক্ত হয়ে সাহিত্য পরিপূর্ণতা পায়। পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য পাঠকের মনে রসের সঞ্চার করে। তাই সাহিত্য পাঠকের মনে অনুভূতি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জীবনমুখী শিক্ষা দেয়। বিশেষ করে মহাকাব্য ও উপন্যাস ধর্মী সাহিত্য জীবনের বিস্তৃত পাঠ, যেখানে বাস্তবতার নিরিখে চিত্রকল্প ও চরিত্রের চলমানতায় পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি জীবনের নানা দিক সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জ্ঞান লাভ করা যায়। তাই সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে একজন পাঠক জীবনের যে কোনো পর্যায় সম্পর্কে পরিপক্ব হয়ে ওঠে এবং বাস্তবজীবনে সাহিত্য থেকে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। সাহিত্য পাঠককে মানবিক করে তোলে। কাহিনি নির্মাণের জন্য সাধারণত একটি রচনায় বিভিন্ন ধরনের চরিত্র থাকে। কাহিনির পরিণতি লক্ষ্য করে একজন পাঠক চরিত্রের দ্বারা ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়। উপন্যাসে সংসার ও সামাজিক জীবনে মানুষের উত্থান-পতনের গল্প পাঠককে বাস্তবজীবনে যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জোগায়। সাহিত্য পাঠককে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে এবং জীবনবোধের গভীর শিক্ষা দেয়। একজন জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের জীবনের পাশাপাশি অন্যের জীবনকেও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দিকনির্দেশনা দিতে পারে। সাহিত্য মানুষকে সৎ ও বিবেকবান করে গড়ে তোলে। ফলে সামাজিক জীবনে মানুষ অন্যায় ও দুর্নীতি এড়িয়ে শৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি যেকোনো অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত করে। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে মানুষের আত্মসমালোচনার সামর্থ্য তৈরি হয় এবং আত্মোন্নতির জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যক্তিজীবনে পাঠকের মানসিকতা শক্তিশালী হয় এবং যে কোনো নেতিবাচকতা এড়িয়ে সফলতার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রেষণা জšে§। সাহিত্য পাঠের ফলে মানুষের মনে মায়া-মমতা ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। যার ফলে দ্বন্দ্ব, হানাহানি, প্রতিহিংসা কমে গিয়ে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের জš§ নেয়। সাহিত্য মানুষকে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে। অতীতে ও বর্তমানে যত বড় বড় গণআন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলোর পেছনে মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং অধিকার সচেতন করেছে সাহিত্য। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য সাহিত্য রচিত হয়েছে, যেগুলো ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে আজও বিপ্লবীদের মনে অনুপ্রেরণা জোগায়। বিপ্লব ধর্মী সাহিত্য রচনার জন্য শোষকের দ্বারা কারাবন্দি হওয়ার নজিরও রয়েছে অনেক লেখকের। রেনেসাঁসের পেছনে রয়েছে সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পুনর্গঠন, নগরায়ণ সবকিছুতেই সাহিত্যের অবদান রয়েছে। মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচনায় দেখানো হয়েছে আর্থসামাজিক পরিবর্তনে সাহিত্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব। যুগে যুগে কৃষক-শ্রমিকের শোষণ ও বঞ্চনার কথা উঠে এসেছে সাহিত্যে এবং এর মাধ্যমে একসময় মানুষ অধিকার সচেতন হয়ে গণআন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছে দাসত্বের শৃঙ্খল। নানা কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুপ্রথা বন্ধ হয়েছে সাহিত্যের আলোচনায় তা উঠে আসার পর। যেমনÑসতীদাহ প্রথা, দাসপ্রথা প্রভৃতি।  এভাবেই সাহিত্য মানুষকে কাল থেকে কালান্তরে সহায়তা করে আসছে। মানবসভ্যতার বিকাশেও সাহিত্যের অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে। যুগে যুগে সাহিত্যে উঠে এসেছে মানুষের ভালো-মন্দ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন।

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কারিগর যেমন নির্ভুলভাবে তার কাজ করতে পারে, তেমনি একজন প্রশিক্ষিত লেখক এমনভাবে সাহিত্য রচনা করেন যাতে তার লেখা পাঠকের জীবনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। পক্ষান্তরে সাহিত্যিক যদি অশ্লীলতা ও কল্পনার অতিরঞ্জনে কাহিনিকে অবাস্তব করে ফুটিয়ে তোলে, কিংবা অপরিণত কোনো লেখক বেখাপ্পা গল্পে বই লেখে, তাহলে পাঠক সেসব বই পড়ে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ভুল তথ্য পাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে পাঠকেরও সচেতনতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা আজকাল প্রকাশনীর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে লেখক ও বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু লেখার মান বাড়ছে না। আগের মতো এখন কোনো লেখক তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। এত এত বইয়ের ভিড়ে ভালো মানের জীবনমুখী শিক্ষাবিষয়ক বই খুঁজে বের করা মুশকিল। যে কেউ যে কোনো বিষয়ে বই লিখছে আজকাল। বইয়ের সামাজিক প্রভাব বিচার করার প্রয়োজন মনে করছে না কেউই। অনেক প্রকাশনী শুধু আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে বই বাজারজাত করে। যার ফলে বইয়ের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এটি মোটেও কাম্য নয়। তবে সচেতন পাঠক ঠিকই ভালো বই ক্রয় করতে জানেন এবং বই পড়ে গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয় যাচাই করতে পারেন। তাই পাঠককে শুধু বই পড়লেই চলবে না, আগে সঠিক নিয়মে বই পড়া শিখতে হবে। সামাজিকতার পরিপন্থি কোনো বিষয় নিয়ে লেখা বই যেন কোনোভাবেই প্রকাশিত না হয় সে ব্যাপারে প্রকাশনীগুলোয় নীতিনির্ধারণীর ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠকের বয়স ও মননের শ্রেণিভেদে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের প্রচারণা ও বিক্রির কাজটি করতে হবে। অনুমোদন ছাড়া বই বাজার থেকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির বিধান জোড়দার করতে হবে। অনেক প্রকাশনী শুধু আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে বই বাজারজাত করে। যার ফলে বইয়ের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এটি মোটেও কাম্য নয়। এছাড়া ইন্টারনেটের যুগে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাঠকের রুচির পরিবর্তনের ফলে সাহিত্যচর্চা অনেকাংশেই কমে গিয়েছে। বর্তমানে এটি সাহিত্যের বিকাশে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তাই তরুণদের সাহিত্য পাঠের প্রতি উৎসাহিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে এবং লেখকদেরও যুগোপযোগী সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি, পাঠকমহলে বই ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে প্রকাশনা ও পাঠের উপযোগিতা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। সঠিক নিয়ম ও কার্যকরী উপায়ে সাহিত্য পাঠ করলে তা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়