হাবিবুর রহমান : আজ ঐতিহাসিক ১৬ জুলাই। গত বছরের এই দিনে পৃথিবীর কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অব¯’ায় রংপুরের রাজপথেই শহি হন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। শহিদ সাঈদ আজও বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের হৃদয় ভাস্বর। যার ছবি প্রত্যেক বাংলাদেশির হৃদয়ে খোদাই করা আছে। বীরোচিত সেই দৃশ্য। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে, দু’হাত দুই দিকে সম্প্রসারিত। তার ভঙ্গিমাই বলে দেয়, ‘বাংলার তরুণরা জেগেছে। বাংলার জনতা আজ সাহস ফিরে পেয়েছে। যতই গুলি চালাও, এই ছাত্র-জনতা আর পিছু হটবে না। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত কেউ আর ঘরে ফিরবে না।’ ১৮ জুলাইয়ের সেই দৃশ্য আজও কেউ ভুলতে পারে না, আজও তিনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে আবু সাঈরে রক্তে রঞ্জিত হয় রংপুরের প্রধান সড়ক। তার তাজা রক্তের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তারপর থেকে আন্দোলনরত তরুণ-তরুণী, জনতা হার মানা ভুলে গেল। সবাই সামনে এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘যত গুলি মারতে পার মার, আমরা এখানে আছি’। আরও কত স্লোগান তার মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে- ‘জাস্টিস, জাস্টিস/ উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘লাশের ভেতর জীবন /দে নইলে গদি ছাইড়া ’দে; ‘আমার খায়, আমার পরে/ আমার বুকে গুলি করে’। এরকমভাবেই ছাত্র-জনতার মেলবন্ধন ঘটে রাজপথে। গি টিকিয়ে রাখার জন্য হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরে লেলিয়ে দেখিয়েছিল। হায়েনার মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অবৈধ অস্ত্র নিয়ে। সঙ্গে ছিল তার আজ্ঞা বহনকারী পুলিশ ও র্যাব। পুলিশ সরাসরি গুলি চালাল আন্দোলনকারীদের ওপর। তাদের সম্মিলিত পৈশাচিক আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি কোলের অবুঝ শিশুও। রেহাই পায়নি নারী, বৃদ্ধ- কেউ। আবু সাঈরে পথ ধরে শহি হন হাজারো মানুষ। আজ আমি সেইসব বীর ‘জুলাই শহিদদের’ স্মরণ করছি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে।
সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সূচনা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন ঘনীভূত হতে থাকে। ‘বৈষম্যবিরোধী’ শব্দটি সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ নাগরিকমণ্ডলীর চেতনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তবে নেতৃত্ব দেন তরুণ ছাত্রছাত্রীরা। উত্তরোত্তর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নিরীহ আন্দোলনকারীরে ওপর সরকার নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চাপিয়ে দিয়ে এই মন-প্রচেষ্টা সীমাহীন নিষ্ঠুরতায় পৌঁছায়। সাধারণ মানুষ দেশের সন্তানদের এই অবাধ হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মেনে নেয়নি। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে তারা দলে দলে রাজপথে নেমে এসে শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করে।
আজকে আমরা আবু সাঈদসহ সেসব বীরের জন্য নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। সাধারণ মানুষের বাংলাশে সাধারণ মানুষের হাতেই ফিরে এসেছে। এখন আবু সাঈ এক পরিবারের সন্তান নয়, বাংলাদেশের সব পরিবারের সন্তান। এখন বাংলাদেশের যত সন্তান সবাই আবু সাঈদের বীরত্বগাথা, বুক পেতে য়োর ছবি দেখে। সরকার বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে তার বীরোচিত আত্মদানের ঘটনাটি সন্নিবেশিত করেছে। ছোট ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সাঈদের বীরত্বগাঁথা গল্প পড়বে তখন তারাও বলবে, ‘আমিও ন্যায়ের জন্য লড়ব, আমিও বুক পেতে বে।’ সেই হলো আবু সাঈ যে দেশের নতুন স্বাধীনতার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেখিয়েছেন। সবার প্রতি অনুরোধ, আবু সাঈদ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমরা যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারি।’
জুলাই শহিদরে স্বীকৃতিস্বরূপ সন দেয়ার বিষয়ে সরকার কাজ করছে। সরকারি ঘোষণার আওতায়, নিহতদের ‘জুলাই শহিদ’ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করা হবে। তাদের সম্মানে বিশেষ পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিভিন্ন সুবিধার ব্যবস্থা করছে সরকার। আহতদের শারীরিক অবস্থার ভিত্তিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে।
‘ক’ শ্রেণিতে অতি গুরুতর আহতদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ন্যূনতম এক চোখ/হাত/পা ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অনুপযোগী, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, সম্পূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাজ করতে অক্ষম বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি’।
‘খ’ শ্রেণির মধ্যে থাকবেন ‘আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি’।
‘গ’ শ্রেণির মধ্যে থাকবেন ‘যারা দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হচ্ছে, চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম হবেন এবং যারা এরই মধ্যে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম’।
আহত জুলাই যোদ্ধারে জন্য দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ এবং সরকার নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে সরকার। শহিদ পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে, সন্তানদের শিক্ষা সহায়তায় এবং আহতরে জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জুলাই যোদ্ধাদের স্বাবলম্বী করতে এককালীন অনুদান এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সহায়তা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে লড়াকু নারীরেও এই তালিকায় থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে শহি পরিবার এবং আহতরা কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, আবাসন সুবিধা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাবেন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকার ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার এবং আহত ছাত্র-জনতার কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করেছে।
অধ্যাদেশের অধীনে ঢাকায় ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ গঠন করা হবে, যা জুলাই অভ্যুত্থানের আদর্শ ও চেতনাকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ নেবে। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরেও অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের সুযোগ রাখা হবে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হবেন অতিরিক্ত সচিব। জুলাই অভ্যুত্থানে সারা দেশের নাগরিক শক্তির এক অসাধারণ ও দুঃসাহসী ঐক্য গড়ে ওঠে, যা চেপে বসা শেখ হাসিনার দীর্ঘ দেড় শকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে উৎখাত করে। কেন সারাদেশের মানুষ এভাবে জেগে উঠল? কারণ ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দেশে সম্পূর্ণভাবে একদলীয় ফ্যাসিস্ট রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পরপর তিনটি নিয়ন্ত্রিত ও একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমেই নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম করে সব রকমের বিরোধী মত ও কার্যক্রম কার্যত রুদ্ধ করে দেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গায়েবি মামলা প্রভৃতি আইনি-বেআইনি নিষ্পেষণে দেশ ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়। বিরোধী মতের প্রকাশ হয়ে ওঠে অপরাধ, গণমাধ্যম নজিরবিহীন আক্রমণের শিকার হয়, রাজনৈতিক নিগড়ে বাঁধা পড়ে বিচারব্যবস্থা। সেই দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করেছিল। তবে ২০২৪ এর আন্দোলন একটি বিষয় প্রকটভাবে সামনে নিয়ে আসে। আন্দোলনে নতুন রাজনীতির নানা লক্ষণ খো যাচ্ছিল, পুরোনো আলের রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলার জন্য জনমানসে আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হলো।
আকাক্সক্ষা ছিল অভিন্ন, যা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সংবিধানের জনগণতান্ত্রিক সংশোধন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনী ব্যব¯’ার পুনর্গঠন, নাগরিকদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কার। সরকার এই জনআকাক্সক্ষার কথা মাথায় রেখে সরকার দেশে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। নির্বাচন ব্যব¯’া সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। পরে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দল ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছেন। এই কমিশন কয়েক দফায় মত বিনিময়ের আয়োজন করেছে। এছাড়া গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনও সংশ্লিষ্ট খাতের সংস্কার সুপারিশ নিয়ে কাজ করেছে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বর্তমানে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের কাজ চলছে। তবে এটা অনস্বীকার্য, অভ্যুত্থানের প্রতি সম্মান জানাতে হলে ওই সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। সেগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজ করছে। এই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল এমন একটি সমাজ গড়া, যেখানে স্বাধীনতা, সমতা ও মর্যাদা হবে সব সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ডের মূলনীতি। আমরা আজ এই সংস্কার যাত্রার অংশ হিসেবে দায়বদ্ধ যা আমরা জাতির প্রতি ঋণ হিসেবে বহন করছি। আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, তা কোনো তু”ছ পরিবর্তন নয়। বরং তা এমন মূলগত রূপান্তর, যা গত ৫৪ বছরেও করা হয়নি। পরিশেষে শহি আবু সাঈদসহ সব জুলাই শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাতে চাই, আমরা চাই এমন পরিবর্তন, যা একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে যেন আর কোনো নতুন ফ্যাসিস্টের উত্থান না ঘটত পারে।