Print Date & Time : 27 August 2025 Wednesday 4:35 am

জেন আলফা অনেক সংবেদনশীল, সাধারণ বিষয় নাকি সমস্যা?

লাবনী আক্তার কবিতা : জেন আলফা কারা? কী রকম এদের আচার-আচরণ? এদের ভবিষ্যৎ কী? আর বর্তমানে এরা কি ঠিক অনুশাসনে বড় হচ্ছে?

জেন আলফা বা Generation Alpha হলো বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রজন্ম, যাদের জন্ম প্রায় ২০১২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে। অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের তরুণ সমাজের কাছে যাদের বাচ্চা বলে মনে হয় তারাই জেন আলফা। এরা বেশিরভাগই এখন ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী। কিন্তু এদের আচার-আচরণের সঙ্গে এদের বয়সটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ইন্টারনেটে কিংবা আমাদের আশেপাশে এই বয়সী শিশু-কিশোরদের দেখলেই আমাদের একটু অদ্ভুত মনে হয়। এদের আচার-আচরণ আমাদের সময়ের মতো নয়। এরা মাঠে খেলতে জানে না, সারাক্ষণ অনলাইনে কাটায়, এরা বেশিরভাগ বাইরের খাবার পছন্দ করে, বাস্তব জগতে এদের তেমন কোনো বন্ধু নেই, এরা কখনো অনেক আত্মবিশ্বাসী, আবার কখনো অনেক বেশি হীনম্মন্যতায় ভোগে। অর্থাৎ এই প্রজন্মকে আমরা অতিরিক্ত সেনসিটিভ বলতে পারি।

এদের অতিরিক্ত সেনসিটিভ হওয়ার পেছনে কয়েকটি সামাজিক, পারিবারিক ও প্রযুক্তিগত কারণ রয়েছে। প্রথমত, এই শিশুগুলো জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেটকে অনেক সহজলভ্য পেয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের ফলে এদের বাইরে খেলাধুলা করার জায়গা কমে গেছে; ফলে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশে যেই সামাজিকীকরণটা হয়, সেটা থেকে এরা অনেকটাই বঞ্চিত হয়েছে। বর্তমান যুগের বাবা-মায়েরা শিক্ষিত হয়েছে। অনেক সময় বাবা-মা উভয়ই চাকরিজীবী হওয়ার ফলে শিশু বাবা-মায়ের সংস্পর্শে আসার সময়ই পায় না। আবার কিছু বাবা-মা সন্তানকে অতিরিক্ত আদর দিয়েও আরও সেনসিটিভ করে তুলছে। আবার এই প্রজন্মের বাচ্চাদের এরকম হওয়ার পেছনে কোভিড ১৯-এর অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। এখন সমস্যা কোথায়? আর কী কী ক্ষতি হচ্ছে?

প্রথমেই বলে রাখা ভালো অতিরিক্ত সেনসিটিভ হওয়ার কারণে তারা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তারা আরো সমস্যায় পড়বে। ছোটবেলা থেকেই তারা রঙিন, দ্রুত পরিবর্তনশীল ও আবেগপূর্ণ কনটেন্ট দেখছে। ফলে তাদের আবেগের ওঠানামা তীব্র হয় এবং খুশি, দুঃখ, ভয় বা রাগ দ্রুত প্রকাশ করে। ছোট থেকেই ফোন, ট্যাব ও টেলিভিশন দেখে বড় হওয়ার ফলে এদের চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরা কোনোকিছুতেই অনেকক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। ফলে ছোট সমস্যাতেই হতাশা, কান্না বা বিরক্তি প্রকাশ করে। অনলাইনে বেশি সময় কাটানোর কারণে এদের নিজের পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে; ফলে কখনও কখনও এরা একাকিত্বে পড়ছে। আবার অনেক পরিবারে মোবাইল/ট্যাব দিয়ে শান্ত রাখা হয়, ফলে শিশুরা শিখে যায় যে কান্না করলে বা জেদ করলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। যখন বাবা-মা সন্তানের সব চাহিদা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে দেন, তখন বাচ্চা না শোনা বা অপেক্ষা করা শেখে না। আবার বাবা-মা যদি সব সময়ই বলে, ‘আমার বাচ্চাই সেরা,’ তবে শিশুটি সমালোচনা বা ব্যর্থতা নিতে পারে না। স্কুলে সামান্য নেগেটিভ ফিডব্যাক পেলেই সে ভেঙে যায় বা কষ্ট পায়। বাইরে খেলাধুলা না করার কারণে রিয়েল-লাইফ সমস্যা সামলানোর দক্ষতা গড়ে ওঠে না। ফলস্বরূপ আবেগের প্রতি তারা বেশি সংবেদনশীল হয়।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, জেন আলফার সেনসিটিভ হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। কিন্তু সময় এখন সাবধান হওয়ার। সময় থাকতে থাকতে এখনই কিছু ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের উচিত এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। তা না হলে এর পরবর্তী প্রজন্ম আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

যাদের জন্ম গত শতকের নব্বইয়ের দশকে হয়েছে, তারা জানে কঠোর শাসন কাকে বলে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এর কিছুই জানে না। একটি বাচ্চাকে বড় করতে এবং ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন কিছু শাসনের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আবার অতিরিক্ত কঠোর শাসন বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই শাসনের মাত্রাটা মধ্যম রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

 

 

শিশুকে আদর করা হবে, কিন্তু তা মাত্রাতিরিক্ত নয়। সব দাবি সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করা যাবে না। শিশুকে ‘না’ বলা শিখতে হবে। যেমন ‘এখন নয়, পরে দেওয়া হবে।’ এতে শিশুর মধ্যে ধৈর্য আর হতাশা সামলানোর ক্ষমতা তৈরি হয়।

শিশু নিজের যে কাজগুলো নিজে নিজে করতে পারে, সেই কাজগুলো তাকে দিয়ে করাতে হবে। এতে করে সে আত্মনির্ভরশীল হবে।

বাইরে খেলাধুলা, টিম-অ্যাক্টিভিটি (খেলাধুলা, স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান) করাতে হবে। এতে তারা অন্যদের সঙ্গে মিশতে শিখবে, হার-জিত মেনে নিতে পারবে।

শিশুকে অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এর পক্ষান্তরে তাকে বই পড়া, ছবি আঁকা, নাচ-গান শেখানো ইত্যাদি বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে।

কথায় বলে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই তাকে শুরু থেকেই সুন্দর একটি কাঠামোতে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে তারা ভবিষ্যতে গিয়ে অতিরিক্ত সেনসিটিভ বা অতিরিক্ত কঠোর না হয়ে যায়। বাবা-মায়ের ভালোবাসা জরুরি, কিন্তু অতিরিক্ত আদর শিশুদের অতিরিক্ত সেনসিটিভ করে তোলে। ভালোবাসা দিতে হবে, তবে সীমারেখাসহ।

লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়