মোহাম্মদ শফিউল্লাহ : দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জ্বালানি নিরাপত্তা একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত না হলে শিল্প উৎপাদন, কৃষি, পরিবহন এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো স্থবির হয়ে পড়ে। দেশের অর্থনীতিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা সংকটের মুখে স্থিতিশীল রাখতে জ্বালানির পর্যাপ্ত মজুত এবং সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তাই জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত ও টেকসই ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়। এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং জাতীয় স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গত এক বছরে দেশের জ্বালানি খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বিভিন্ন সাহসী ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাশ্রয় নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা শক্তিশালী করার পথ প্রশস্ত করেছে। এই সাফল্য এসেছে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের হাত ধরে। যেমন পুরোনো দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি-সংক্রান্ত একটি বিশেষ বিধান বাতিল করে সরকারি কেনাকাটার সাধারণ নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়েছে, যা সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি আমদানির সুযোগ তৈরি করেছে। পাশাপাশি দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ও সিস্টেম লস কমানোর মতো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনা হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ের মাধ্যমে সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার ভিত্তিও মজবুত করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে, আর্থিক শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি টেকসই জ্বালানি খাত গড়ে তোলা সম্ভব, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নীতিগত পরিবর্তন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জ্বালানি আমদানিতে উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিল করে ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮’ অনুসরণ করার ফলে MSPA স্বাক্ষরকারী ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম প্রিমিয়ামে ৪৯টি কার্গো আমদানি করা সম্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে ৩০২ কোটি ৭০ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। একইভাবে পেট্রোবাংলা ও ওমানের ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেডের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ সালে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে ১৭টি এলএনজি কার্গো সাশ্রয়ী মূল্যে আমদানি করা হবে, যা ৩০৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা সাশ্রয় করবে। এছাড়া জি-টু-জি নেগোসিয়েশন এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানিতে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার ৫৪ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে এবং দিনাজপুর পাথরখনির জন্য বিস্ফোরক ক্রয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮০ টাকা সাশ্রয় করা গেছে। এই পদক্ষেপগুলো প্রমাণ করে, সঠিক নীতি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।
রাজস্ব বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস কমানোর লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বেশ কয়েকটি কার্যকর ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা সরকারের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নতুন গ্যাস বিক্রয় চুক্তি (জিএসএ) সম্পাদন। কাফকো ও লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ-এর মতো দুটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন চুক্তির মাধ্যমে সরকারের বার্ষিক অতিরিক্ত রাজস্ব বাড়বে যথাক্রমে ৬৪০ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং ৪৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এই পদক্ষেপটি সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস তৈরি করেছে। এছাড়া গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় বিদ্যমান সিস্টেম লস হ্রাসের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই রোডম্যাপের ফলস্বরূপ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সিস্টেম লস হ্রাস পেয়েছে, যা সরকারের জন্য ২১৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব বৃদ্ধি করবে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির মাধ্যমে অপচয় রোধ করে সরকারের আয় বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি বিইআরসি কর্তৃক প্রাকৃতিক গ্যাসের শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ শ্রেণিতে মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বার্ষিক অতিরিক্ত ৯৮ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি হবে। এসব পদক্ষেপ সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জ্বালানি খাতের কার্যকারিতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাফল্যের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। এই সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে। বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন তিনটি রিগ ক্রয়সহ ১৫০টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৯টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে দৈনিক ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে, যার ফলে বার্ষিক ১৯৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। এটি শুধু আর্থিক সাশ্রয়ই নয়, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ব্যয় কমানো হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্প থেকে ১৯৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন প্রকল্প থেকে ৪৫ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকে ৩১ কোটি ৪ লাখ টাকা সাশ্রয়। এছাড়া জিটিসিএল এর অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে গ্যাস স্টেশন স্থাপন প্রকল্প, কাস্টডি ট্রান্সফার ফ্লো মিটার স্থাপন প্রকল্প, বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং কূপ ওয়ার্কওভারসহ আরও কয়েকটি ছোট-বড় প্রকল্প থেকে মোট ৯২ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে এবং আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং আর্থিক চাপ কমাতে আন্তর্জাতিক সহায়তাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এই উদ্যোগের একটি বড় সাফল্য হলো বিশ্বব্যাংক (ওউঅ) কর্তৃক ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের গ্যারান্টি ফ্যাসিলিটি অনুমোদন করানো। এই গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাটি আগামী নভেম্বর ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ঝুঁকি কমানো এবং ব্যয় সাশ্রয় করা। এই ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে আগামী সাত বছরের মধ্যে মোট ২ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে, যা সরকারি কোষাগারের ওপর চাপ কমানোর পাশাপাশি জ্বালানি খাতের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সুবিধাটি এখানেই থেমে থাকবে না। পরে এর পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে জ্বালানি আমদানির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল অর্থায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। এটি শুধু তাৎক্ষণিক আর্থিক সাশ্রয়ই নয়, বরং দেশের জ্বালানি খাতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা এবং স্থিতিশীলতার জন্য একটি মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গত এক বছরে একটি অসাধারণ সাফল্যের গল্প তৈরি করেছে। এই সময়ে কেবল গতানুগতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি, বরং বিচক্ষণ নীতিগত পরিবর্তন, কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা এবং দূরদর্শী কৌশলগত পরিকল্পনা দিয়ে জ্বালানি খাতকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষ বিধান বাতিল করে সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস কমানোর মতো অভ্যন্তরীণ সংস্কার—প্রতিটি পদক্ষেপই সরকারের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতার পরিচায়ক।
আর্থিক সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তা কেবল কিছু নির্দিষ্ট প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জ্বালানি আমদানি, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য পরিচালন ব্যয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় প্রমাণ করে যে, সঠিক নেতৃত্বের অধীনে সম্পদের অপচয় রোধ করা এবং জনগণের অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। কাফকো ও লাফার্জহোলসিমের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে এবং সিস্টেম লস কমিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করা সরকারের আয়ের উৎসকে আরও স্থিতিশীল করেছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের গ্যারান্টি ফ্যাসিলিটির মতো আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
এই সামগ্রিক প্রচেষ্টা কেবল কিছু পরিসংখ্যান বা সাফল্যের তালিকা নয়, বরং এটি দেশের জ্বালানি খাতের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এই পথ ধরে চলতে পারলে দেশের জ্বালানি খাত ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও জনকল্যাণমুখী হয়ে উঠবে।
পিআইডি নিবন্ধ

Discussion about this post