ড. মতিউর রহমান : জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেক (Ulrich Beck) ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘Risk Society: Towards a New Modernity’-এ যে বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন, তা আজ বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য এক গভীর বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। বেক দেখান, আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ এমন সব ঝুঁকির মুখোমুখি হয়, যা প্রকৃতি নয়, বরং মানবসমাজ নিজেই তৈরি করেছে। শিল্পায়ন, প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার, লাগামহীন নগরায়ণ, পরিবেশগত ভুল সিদ্ধান্ত এবং শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা—সব মিলিয়ে তৈরি হয় ‘নির্মিত অনিশ্চয়তা’ (Manufactured Uncertainty)। এই ঝুঁকিগুলো দৃশ্যমান নয়, সীমান্ত মানে না এবং আচমকা সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ আজ এই তত্ত্বের এক স্পষ্ট উদাহরণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের হাত ধরে দেশটি যেমন আধুনিকতার সুফল ভোগ করছে, তেমনি প্রবেশ করেছে গভীর ‘ঝুঁকি সমাজে’। ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বরের শক্তিশালী ভূমিকম্প আতঙ্ক, জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুততর প্রভাব, আর ঢাকার মতো মেগাসিটির ভঙ্গুর অবকাঠামো, সেই সঙ্গে ২০২৫ সালের প্রথম দিককার চট্টগ্রাম ইপিজেড, মিরপুরের রাসায়নিক গুদাম এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেকের সতর্কবাণীকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশে ঝুঁকি এখন আর কেবল প্রাকৃতিক নয়, তা মূলত সামাজিক-পারিপার্শ্বিক (Socio-Ecological), অর্থনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার ফসল।
বেক মনে করেন, প্রথম আধুনিকতা প্রাকৃতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেষ্ট ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় আধুনিকতা এমন এক ঝুঁকি তৈরি করেছে, যা নিজেই নিজের ফল। এই তত্ত্বের পাঁচটি মূল ধারণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গভীরভাবে প্রযোজ্য—
ক. নির্মিত অনিশ্চয়তা (Manufactured Uncertainty): বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নির্মিত অনিশ্চয়তার মূল কারণ হলো ‘উন্নয়ন বনাম নিরাপত্তা’-এর ভারসাম্যহীনতা। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশগত এবং নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধিবিধান উপেক্ষা করা হয়েছে। যেমন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ এবং বিল্ডিং কোড না মানা, যা প্রকৃতি নয়, বরং মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যোগসাজশের ফল। অগ্নিকাণ্ডগুলোও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধ রাসায়নিক গুদাম স্থাপন, কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না থাকা এবং জরুরি বহির্গমন পথের অভাব—এগুলো সবই মানুষের তৈরি ঝুঁকি।
খ. ঝুঁকির বৈশ্বিকতা ও বৈষম্য (Globalization and Inequality of Risk): বেক দেখান, আধুনিক ঝুঁকি স্থান ও কাল মানে না; তা বৈশ্বিক এবং অসমভাবে বণ্টন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এর সবচেয়ে বড় শিকার। দেশটি বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে নগণ্য ভূমিকা রাখলেও, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা, নদীভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো বৈশ্বিক শিল্পায়নের ফল ভোগ করছে। এই ঝুঁকিগুলো সীমান্তহীন, কিন্তু এর আঘাতের শিকার হয় সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা ঝুঁকির উৎপাদনে সবচেয়ে কম দায়ী; যেমন উপকূলীয় দরিদ্র কৃষক এবং শহরের বস্তিবাসী, যারা বন্যা, লবণাক্ততা, এবং অগ্নিকাণ্ডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করতে বাধ্য হয়।
গ. অদৃশ্যতা ও জ্ঞাননির্ভরতা (Invisibility and Knowledge Dependency): আধুনিক ঝুঁকিগুলো দৃশ্যমান নয় (যেমন, কাঠামোগত দুর্বলতা, তেজস্ক্রিয়তা বা ওজোন স্তরের ক্ষয়)। এগুলো বুঝতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মডেল এবং বিশেষজ্ঞের দরকার হয়। বাংলাদেশেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বা জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সাধারণের চোখে ততটা দৃশ্যমান নয়, যতটা দৃশ্যমান তাৎক্ষণিক বন্যা বা অগ্নিকাণ্ড। এই অদৃশ্য অবস্থা নীতিনির্ধারণ ও জনগণের সচেতনতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকিকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির বাইরে বিবেচনা করা হয় না, ফলে আগাম প্রস্তুতি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
ঘ. ঝুঁকির মনোবিজ্ঞান (Psychology of Risk): ঝুঁকি শুধু ভৌত বা অর্থনৈতিক নয়, এটি মানুষের মনে ভয়, অনিশ্চয়তা ও কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করে। ২০২৫ সালের ভূমিকম্পের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজব, ভবনধসের ভীতি এবং অগ্নিকাণ্ডের পর উদ্ধারকাজে বিলম্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের সংশয় দেখিয়েছে যে ঝুঁকি ভৌত নয়, সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিকও। যখন মানুষ বিশ্বাস করে না যে ভবন নিরাপদ, উদ্ধারকাজ দ্রুত হবে বা তথ্য নির্ভরযোগ্য, তখন এই ‘নির্মিত অনিশ্চয়তা’ সামাজিক আতঙ্কে রূপ নেয়।
ঙ. আত্ম–প্রতিফলনশীল আধুনিকতা (Reflexive Modernization): এটি এমন একটি পর্যায় যেখানে আধুনিকতা নিজেই নিজের সমস্যা এবং ভঙ্গুরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশে ঘনঘন দুর্যোগ, বিশেষ করে বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বা জনবহুল কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সমাজ বাধ্য হয় উন্নয়নের পদ্ধতি নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে। এটি সমাজের ভেতরে পরিবর্তন ও সচেতনতা তৈরির একটি সুযোগ তৈরি করে।
নগর ভঙ্গুরতা হলো সেই প্রধান ক্ষেত্র যেখানে বেকের তত্ত্বের আন্তঃসংযুক্ত ঝুঁকির ধারণাটি সবচেয়ে তীব্রভাবে কার্যকর। ঢাকা শহর এই আন্তঃসংযোগের সবচেয়ে তীব্র উদাহরণ।
ক. অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অগ্নিঝুঁকি: ঢাকার মতো মেগাসিটির অনিয়ন্ত্রিত বহুতল নির্মাণ, নাজুক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যানজট, ঘনবসতি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অবৈধ রাসায়নিক গুদাম ও অপরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল নগরকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যেখানে একটি ঝুঁকি অন্য ঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ২০২৫ সালের অগ্নিকাণ্ডগুলো এই ভঙ্গুরতার চরম বহিঃপ্রকাশ। মিরপুরের শিয়ালবাড়ীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধ রাসায়নিক গুদামের উপস্থিতি নির্দেশ করে, মুনাফার স্বার্থে মানুষের জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ইপিজেডের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে বা ঢাকার কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে যে, ফায়ার কোড মানা হয়নি, জরুরি বহির্গমন পথগুলো অবরুদ্ধ ছিল, এবং তদারকি ব্যবস্থা ছিল দুর্বল।
খ. ভূমিকম্প–অগ্নিকাণ্ড–অবকাঠামো বিপর্যয় চক্র: এই ঝুঁকির আন্তঃসংযোগ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে। একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে দুর্বল অবকাঠামো ধসে পড়ার পাশাপাশি শর্টসার্কিট এবং গ্যাসলাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে। যানজট ও সরু রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে পারবে না, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা পানির সরবরাহ ব্যাহত করবে এবং ভঙ্গুর বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনগুলো পরিস্থিতিকে আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে। এভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিজে যতটা না বিপজ্জনক, তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এই আন্তঃসংযুক্ত, মানুষের তৈরি ভঙ্গুরতা।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের নির্মিত বৈশ্বিক ঝুঁকি, যা স্থানীয়ভাবে নগর ভঙ্গুরতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটকে ত্বরান্বিত করছে।
ক. জলবায়ু–স্থানান্তর–নগর চাপ: বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ফলস্বরূপ ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীভাঙন উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। জীবিকার সন্ধানে এই জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তিগুলোতে ভিড় করছে, যা এরই মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এই বস্তি এলাকাগুলো অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ, দাহ্য পদার্থের সহজলভ্যতা এবং ঘনত্বের কারণে অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি নগরীর অগ্নিঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা এক চেইন রিয়্যাকশন।
খ. ঝুঁকির রাজনৈতিক অর্থনীতি: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈশ্বিক অর্থায়ন নির্ভর করে জটিল রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর। দুর্বল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে প্রায়ই জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। দেশেও জলবায়ু অভিযোজনের অর্থায়ন এবং সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য দেখা যায়; দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঝুঁকির শিকার হলেও অভিযোজন প্রকল্পের সুবিধা পায় প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এই বৈষম্য বেকের ঝুঁকির অসম বণ্টনের ধারণাকেই সমর্থন করে।
আধুনিক ঝুঁকি মোকাবিলায় জনগণের আস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দুটি অপরিহার্য উপাদান, কিন্তু বাংলাদেশে এই দুই ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে।
ক. সামাজিক আতঙ্ক ও অবিশ্বাস: ঘনঘন দুর্যোগ, বিশেষ করে ২০২৫-এর অগ্নিকাণ্ড এবং ভূমিকম্প কর্তৃপক্ষের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস আরও গভীর করেছে। যখন একটি দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শত শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, তখন তা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক আস্থাকে দুর্বল করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজবগুলো প্রমাণ করে যে, নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে মানুষ আতঙ্কের আশ্রয় নেয়। বেকের ভাষায়, এটি হলো আধুনিক সমাজের এক ধরনের ‘আস্থার শূন্যতা’।
খ. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক শক্তিশালী হলেও বেকের ‘institutional deficit’ বা প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি এখানে প্রকট। ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ, অগ্নিনিরাপত্তা পরিদর্শন এবং অবৈধ রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদে রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং সমন্বয়ের অভাবে তা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না। মিরপুর বা পুরান ঢাকার অবৈধ রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদে বছরের পর বছর ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গগুলো ঝুঁকি মোকাবিলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং তা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার শিকার।
উলরিখ বেক ঝুঁকির মধ্যে সম্ভাবনার কথাও বলেন। যখন ঝুঁকি এতটাই প্রবল হয় যে তা উপেক্ষা করা যায় না, তখন সমাজ আত্মসমালোচনামূলক হয়ে ওঠে। এই আত্মসমালোচনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকি-সচেতন আধুনিকতা’ (Risk-Conscious Modernity) তৈরি করতে হবে।
ক. উন্নয়নের ধারণার পরিবর্তন: উন্নয়নকে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ, সমতাভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন হিসেবে দেখতে হবে। জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) এবং ফায়ার কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, রেট্রোফিটিংয়ের উদ্যোগ নেয়া এবং নির্মাণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর (যেমন রাজউক) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদারকি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
খ. সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: ঝুঁকি মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সামাজিক আস্থা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে ঝুঁকি উৎপাদনকারী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং ঝুঁকির শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিমুক্ত আবাসন ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ভূমিকম্প, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অগ্নিকাণ্ডকে পৃথকভাবে না দেখে, একে অপরের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় ঘনবসতি নিয়ন্ত্রণ, জরুরি যান চলাচলের জন্য রাস্তা প্রশস্ত করা এবং অবৈধ গুদাম ও কারখানার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ঘ. তথ্য ও জনসচেতনতা: দুর্যোগ প্রস্তুতি, অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া এবং ঝুঁকির বিজ্ঞানসম্মত তথ্য প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে, আগাম প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উলরিখ বেকের রিস্ক সোসাইটি তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, আমরা প্রাকৃতিক ঝুঁকির চেয়ে সামাজিকভাবে নির্মিত ঝুঁকির মধ্যেই বেশি বসবাস করছি। ভূমিকম্প, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অগ্নিকাণ্ডের মতো বিপর্যয়গুলো মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং মুনাফামুখী উন্নয়নের সরাসরি ফল। ঝুঁকি সমাজ শুধু গবেষণার ধারণা নয়, এটি বাংলাদেশের কোটি মানুষের, বিশেষ করে নগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
বেকের তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, প্রথম আধুনিকতার প্রতিষ্ঠান দিয়ে দ্বিতীয় আধুনিকতার ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সমাধান নিহিত আছে কাঠামোগত পরিবর্তনে। নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জনগণের জীবনকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। ঝুঁকি নিয়তি নয়; এটি মানুষের তৈরি এবং মানুষের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই পুনর্গঠিত হতে পারে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে, আমরা আজ কতটা সক্ষম হয়ে উঠি আমাদের নির্মিত অনিশ্চয়তাকে বুঝতে, স্বীকার করতে ও সামষ্টিকভাবে মোকাবিলা করতে। উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে পৃথক না রেখে একই কাঠামোয় বিবেচনা করে তথ্যস্বচ্ছতা, জনসম্পৃক্ততা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি আরও স্থিতিশীল, ন্যায়সংগত ও ঝুঁকি-সহনশীল সমাজ গঠনের পথে এগোতে পারবে।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post