রামিসা রহমান : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) শিক্ষার মান না বাড়লেও টিউশন ফি বেড়েছে। কিউএস ন্যাশনাল র্যাংকিংয়ে ২৩তম অবস্থানে থাকলেও গত তিন বছরে টিউশন ফি বেড়েছে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাকরির বাজারে ইউএপির কোনো অবস্থান নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সুনাম নেই। নেই কোনো গবেষণা, শিক্ষার মানোন্নয়নে নেই কোনো উদ্যোগ। কেবল মনোযোগী টিউশন ফি বৃদ্ধিতে।
জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগে টিউশন ফি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অথচ সেই হারে শিক্ষার মান, গবেষণা, লাইব্রেরি কিংবা অবকাঠামোগত উন্নতি হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাড়তি টাকা দিয়ে তাদের কোনো সুবিধাই মিলছে না, বরং প্রতিনিয়ত ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
তথ্য মতে, ফার্মেসি বিভাগে ২০২২ সালে টিউশন ফি ছিল ৮ লাখ ৭৩ হাজার ২০০ টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ২৯ হাজার টাকায়। তিন বছরে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০০ টাকা বেড়ে শতকরা প্রায় ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। আবার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০২২ সালে টিউশন ফি ছিল ৭ লাখ ১৩ হাজার ২০০ টাকা। ২০২৫ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৮ হাজার ৭০০ টাকায়। এতে বেড়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা, যা শতকরা প্রায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০২২ সালে যেখানে ফি ছিল ৭ লাখ ৮ হাজার ৭০০ টাকা, ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ টাকায়। এতে বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বা প্রায় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। তবে আর্কিটেকচার বিভাগে দেখা যায় ভিন্ন পরিস্থিতি। ২০২২ সালে এই বিভাগের ফি ছিল ৯ লাখ ১০ হাজার ৭০০ টাকা, যা ২০২৫ সালে সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ টাকায়।
ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শিহাব শেয়ার বিজকে জানান, লাগামহীন এই ফি বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষার মানে কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং শ্রেণিকক্ষের সীমাবদ্ধতা, ল্যাবের যন্ত্রপাতির দুর্বল অবস্থা, লাইব্রেরির স্বল্পতা, অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব এবং গবেষণার সীমিত সুযোগ তাদের শিক্ষাজীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করছে। ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী শিহাব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার মানের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে মুনাফার দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন। তার মতে, শ্রেণিকক্ষ সীমিত থাকায় অনেক সময় তাদের এক ক্লাস শেষ হওয়ার পর তিন ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ফলে দিনের পড়াশোনা শেষ হতে রাত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, গবেষণার জন্য কোনো সুযোগ নেই, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই বা আন্তর্জাতিক জার্নাল নেই বললেই চলে। এতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানচর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের জন্য বৃত্তির সুযোগ সীমিত। কিন্তু এসব কারণে যারা মেধাবী তারাও এসব সুযোগ পাচ্ছেন না।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিক আহমেদ বলেন, প্রতি বছর নানা অজুহাতে অতিরিক্ত চার্জ নেয়া হয়। অথচ সেই খরচের সঠিক ব্যাখ্যা কখনোই দেয়া হয় না। তার মতে, পড়াশোনার চেয়ে খরচ মেটানোই এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের টিউশন ফি যতটা বাড়ছে, সেই অনুপাতে কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। বরং একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে প্রতি বছর।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘একজন শিক্ষককে একসঙ্গে একাধিক বিষয়ে ক্লাস নিতে হয়। এতে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ পান না। ল্যাবের যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। ফলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে গিয়ে নিয়মিত সমস্যার মুখে পড়তে হয়। তারা বলেন, শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে অনেক সময় দিনে সব ক্লাস শেষ হতে রাত ৮টা পর্যন্ত লেগে যায়। একদিনের মধ্যে সব ক্লাস শেষ করার জন্য শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা মানসিকভাবে ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীরা আরও জানান, লাইব্রেরিতে বসার জায়গা নেই, আন্তর্জাতিক জার্নাল অ্যাক্সেস নেই বললেই চলে। মানসিক স্বাস্থ্য বা একাডেমিক কাউন্সেলিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। অথচ টিউশন ফি দিতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।’
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের চেয়ারপারসন, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ মাহবুবা হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, যোগ্য শিক্ষকের সংকট তাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বেতন দিতে না পারায় অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তাদের জায়গায় নতুন বা অতিথি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তবে এতে মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকের ঘাটতি স্বীকার করতেই হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি নতুন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে।’
ফার্মাসি বিভাগের প্রধান ড. মো. শাহরিয়ার শেয়ার বিজকে বলেন, তাদের বিভাগের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে ল্যাপটপ সবকিছুই কার্যকর আছে। তার মতে, যদি কোনো সমস্যা থাকত, তাহলে ইউজিসি কখনোই তাদের অনুমোদন দিত না। তিনি বলেন, টিউশন ফি বাড়ানোর বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত, শিক্ষকরা এতে জড়িত নন। কিন্তু তার এই দাবির সঙ্গে একমত নন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবি, ফার্মাসি বিভাগেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। একজন শিক্ষককে একাধিক বিষয় পড়াতে হয়। ল্যাবের যন্ত্রপাতির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় পড়াশোনায় বড় ধরনের সমস্যা হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব দিকে নজর না দিয়ে শুধু নতুন ফি কাঠামো নির্ধারণে ব্যস্ত।
ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনের চেয়ারম্যান এসএমএ ফায়েজ এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন না করে যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কেবল টিউশন ফি বাড়ায়, তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তার মতে, শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা, কাউন্সেলিং এবং মানসম্মত লাইব্রেরি সুবিধা নিশ্চিত করা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক দায়িত্ব।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীর একজন অভিভাবক জানান, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমরা অভিভাবকরাও ক্ষুব্ধ। সন্তানদের ভালো শিক্ষার আশায় তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর ফি বাড়ছে অথচ শিক্ষার মান আগের মতোই রয়ে গেছে। এতে পরিবারগুলো প্রচণ্ড আর্থিক চাপে পড়ছে। তার কথায়, ‘আমাদের সন্তানরা প্রতিদিন ক্লাসে গিয়ে যে সমস্যার মুখে পড়ছে, তার তুলনায় আমরা যে টাকার জোগান দিচ্ছি সেটা অনেক বেশি। অথচ কর্তৃপক্ষ শুধু টাকা বাড়ানোর দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে।’
সবশেষে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, লাগামহীন ফি বৃদ্ধি আর সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউএপিতে বাড়তি ফি দিতে হলেও শ্রেণিকক্ষ, গবেষণা, লাইব্রেরি বা মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। একদিকে শিক্ষকের সংকট, অন্যদিকে পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব, তার ওপর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অনুপস্থিতি মিলিয়ে শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেবল আর্থিক খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, অথচ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে উপেক্ষা করছেন।
শিক্ষার মানোন্নয়ন না করে শুধু টিউশন ফি বৃদ্ধি করলে শিক্ষার্থীরা একসময় হতাশ হয়ে পড়বে। এতে দেশের উচ্চশিক্ষার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল নয়, বরং গবেষণা, উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে। অথচ ইউএপিতে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ফি বাড়লেও সেই পরিবেশ নেই।
পরিশেষে বলা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফি বৃদ্ধি কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে ইউএপির মতো প্রতিষ্ঠানে লাগামহীন ফি বৃদ্ধি যখন শিক্ষার মান বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে না, তখন তা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীরা চায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা, যেখানে তারা যে অর্থ ব্যয় করছে তার সমপরিমাণ সুবিধা ও মানসম্মত শিক্ষা পাবে। অন্যথায় এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও আর্থিক দুরবস্থা আরও বাড়বে, যা দেশের শিক্ষা খাতের জন্যও অশনিসংকেত বয়ে আনতে পারে।

Discussion about this post