Print Date & Time : 26 August 2025 Tuesday 10:26 pm

টেলিমেডিসিনে ঝোঁক বাড়ছে রোগীর

রামিসা রহমান : ঘরে বসে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ফলে প্রযুক্তিনির্ভর টেলিমেডিসিন সেবা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে এর বাজার বড় হচ্ছে। এতে যোগ হচ্ছেন নামকরা দক্ষ ডাক্তাররা। বড় বড় ওষুধ কোম্পানিও এখন টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। এই সেবা পেয়ে রোগীরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যাতায়াতে ঝক্কি-ঝামেলা এড়িয়ে দূরের রোগীরাও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন।
জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য কৌশল (২০২৩-২০২৭) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক রোগ নির্ণয়, রিয়েল-টাইম রোগ পর্যবেক্ষণ এবং তথ্যনির্ভর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কাছে স্মার্ট, দক্ষ ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে এআই এবং বিগ ডেটা সংযুক্তকরণ বাড়ানো ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য সচেতনতা বিস্তৃত করার একটি সাহসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যাতে প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যসেবা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছে যায়। বর্তমানে টেলিমেডিসিনের বাজারমূল্য ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার (১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা), যা প্রতি বছর গড়ে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১০টি টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কয়েক হাজার থেকে শুরু করে লাখো রোগীকে সেবা দিচ্ছে।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো হলোÑডকটাইম, প্রাভা হেল্থ, টনিক (গ্রামীণফোন), মায়া অ্যাপ, ডককিউর, ডক্টরোলা, ডিজিটাল হসপিটাল (বাই টেলেনর হেল্থ), আমারল্যাব , আরোগ্য, সিএমইডি, মেডইজি, পাল্স টেকওয়েব, লাইফপ্লাস বিডি, ইনস্পিরা অ্যাডভাইজারি অ্যান্ড কনসাল্টিং প্রভৃতি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম প্রজšে§র টেলিমেডিসিন উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ডক্টরোলা। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের ৫৫৬টিরও বেশি কনসালটেশন সেন্টার ও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। ডক্টরোলার হটলাইন ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রোগীরা সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে পারেন। যদিও প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক রোগীর সংখ্যা বা বার্ষিক আয়ের তথ্য প্রকাশ করে না, তবে খাতসংশ্লিষ্টদের মতে এই প্ল্যাটফর্ম প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ করে।
অন্যদিকে বাসায় বসেই ল্যাব টেস্ট করানোর সুবিধা দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘আমার ল্যাব’। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিন গড়ে ৬০০-এর বেশি টেস্ট হয় এবং চার বছরে তারা ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহককে সেবা দিয়েছে। এই সেবার মাধ্যমে রোগীরা বাড়িতে বসেই রক্ত, ইউরিন বা অন্যান্য পরীক্ষা করাতে পারে, যার নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে রিপোর্ট সরবরাহ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটালভাবে সম্পন্ন হয়। ‘আমার ল্যাব’ও তাদের বার্ষিক আয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেনি, তবে ক্রমবর্ধমান টেস্ট ভলিউমের কারণে এর বাজারমূল্য দ্রুত বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইনেসিস আইটি ও গ্রামীণফোনের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল হসপিটাল প্রথম থেকেই বৃহৎ পরিসরে টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছে। চালু হওয়ার পর থেকে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১৫ লাখের বেশি টেলিকনসালটেশন সম্পন্ন হয়েছে। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও সহজে এই সেবায় যুক্ত হতে পারছে।
জানা গেছে, ওষুধ সরবরাহ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান দিয়ে আলোচনায় এসেছে ‘আরোগ্য’। ছয় লাখের বেশি রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারী নিয়ে প্ল্যাটফর্মটি দেশের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন ফার্মেসিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে আরোগ্য’র আয় চারগুণ বৃদ্ধি পায়, যা বিনিয়োগকারীদের নজর কাড়ে। যদিও প্রতিদিনের রোগীর সংখ্যা প্রকাশিত নয়, তবে ওষুধ অর্ডারের পরিমাণ ও অ্যাপ ব্যবহারের প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
এদিকে সিএমইডি হেলথ মূলত দীর্ঘমেয়াদি রোগ ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য মনিটরিং সেবা দেয়। তাদের সিস্টেমে বর্তমানে ৩৩ লাখের বেশি রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারী এবং ১৬ লাখেরও বেশি মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে। স্মার্ট ডিভাইস ও অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রেসার ও গ্লুকোজ মনিটরিং করতে পারে।
অপরদিকে স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও নীতি সহায়তার ক্ষেত্রে ইনস্পিরা অ্যাডভাইজারি অ্যান্ড কনসাল্টিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি রোগী সেবা না দিলেও সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিভিন্ন ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রকল্পে পরামর্শ, গবেষণা ও কৌশলগত সহায়তা দিয়ে আসছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও বিগ ডেটা ব্যবহার করে রোগ শনাক্তকরণ ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি একাধিক প্রকল্পে কাজ করছে।
এছাড়া প্রাভা হেলথ ২০১৮ সালে চালু হয়ে দ্রুতই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তারা উচ্চমানের ইন-ক্লিনিক সেবা, টেলিহেলথ, ডায়াগনস্টিক ও ফার্মেসি সেবা একত্রে প্রদান করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোগী এখানে সেবা নিয়েছে এবং ২০২০ সালে তাদের মোট কনসালটেশনের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল অনলাইন বা টেলিহেলথের মাধ্যমে।
মেডইজি ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপটি অনলাইনে ডাক্তার পরামর্শ, ল্যাব টেস্ট ও ওষুধ সরবরাহের মতো একাধিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করে। এটি এখন পর্যন্ত ৭ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থায়ন পেয়েছে। এছাড়া জানা যায়, গত বছর মেডইজি প্রায় ৩৫-৪০ কোটি টাকা আয় করেছে ।
পালসটেকওয়েব ২০২১ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু রোগী নয়, ফার্মেসিগুলোকেও ডিজিটাল সমাধান দিচ্ছে। তাদের মেডিপস সফটওয়্যার এবং মেডবক্স বি২বি সরবরাহ শৃঙ্খল সমাধান ফার্মেসি ব্যবসার ব্যবস্থাপনাকে সহজ করছে। এছাড়া তাদের মেডিকার্ট অনলাইন ফার্মেসি প্ল্যাটফর্ম গ্রাহকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পণ্য কেনাকে সহজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দুই লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থায়ন পেয়েছে।
ডকটাইম এই প্ল্যাটফর্মটি বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য অনলাইনে ডাক্তার পরামর্শ সেবা দেয়। এটি রোগীদের তাদের চাহিদামতো চিকিৎসক খুঁজে বের করতে এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে সাহায্য করে। এই প্ল্যাটফর্মে ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, হƒদরোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি অর্থায়ন পায়নি, তবে এটি একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
মায়া অ্যাপ ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মায়া অ্যাপ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মোবাইল অ্যাপভিত্তিক এই প্ল্যাটফর্মটি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দূরবর্তী কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করে। এটি ২ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়ন পেলেও বর্তমানে এটি বন্ধ রয়েছে।
লাইফপ্লাস বিডি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপটি রোগী ও ডাক্তারের জন্য মেডিকেল সার্ভিস বুকিং সফটওয়্যার সরবরাহ করে। অ্যাপের মাধ্যমে রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স, হোম কেয়ার, ওষুধ সরবরাহ এবং ডায়াগনস্টিক টেস্টের বুকিং করতে পারে। একটি সূত্র অনুযায়ী, এই প্ল্যাটফর্মটি এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও বেশি রোগীকে সেবা দিয়েছে।
গ্রামীণফোনের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান টনিক। বর্তমানে এর কার্যক্রম বন্ধ আছে। সরকারও এই খাতের প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ২ হাজার তিনশ’র বেশি কমিউনিটি ই-সেন্টার ও টেলিসেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অনলাইন চিকিৎসা, স্বাস্থ্য তথ্য ও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছেন মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ কাশেম শেয়ার বিজকে বলেন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তার ভাষায়, এখন শুধু প্রয়োজন সেবার মান নিশ্চিত করা এবং ডাক্তারদের ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করে তোলা।
টেলিমেডিসিন উদ্যোক্তা বলেন, যদি বিনিয়োগ ও নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই খাতের বাজার আকার এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বর্তমানে টেলিমেডিসিন খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলোÑপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দৈনিক রোগীর সংখ্যা ও বার্ষিক আয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করছে। বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের মতে, এ ধরনের স্বচ্ছতা থাকলে বাজার আরও দ্রুত বাড়তে পারত। তবুও ব্যবহারকারীর প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তির প্রসার ও সরকারি সহায়তা মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে এই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।